ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০
ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে কাজটি করি তা হলো আইফোন খুলে মেসেজ চেক করা। গত মার্চ একুশে (২০২০) ও তাই করতে গিয়ে প্রথমেই চোখ পড়লো আমার এক ভাগ্নে মিতুলের বার্তার উপর। তেমন অপ্রত্যাশিত না হলে ও খবরটি একবুক যাতনা ও অজস্র স্মৃতি নিয়ে আমাকে কিছু সময়ের জন্য যেন অন্য জগতে নিয়ে গেল। অজস্র সুখ স্মৃতির পাশাপাশি সুকঠিন কিছু কষ্ট অনুভূতি যেন হ্রদয়কে এফোড় ওফোড় করে দিলো। খোদেজার সুন্দর মুখটা মনে পড়লে সবসময়ই তাঁর দুঃখ কষ্টের কথাই মনে পড়ে। তাঁর স্বামী শামসু। মাথায় জাঁকরা চুল , ফরসা গায়ের রং রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলানোর প্রানান্তকার চেষ্টায় কালচে হলুদের মত হয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় এককালে খুব সুপুরুষ ছিলো। আমার বোনজি ও খুব সুন্দরী ছিল। হলুদ বরণ ছিল গায়ের রঙ। বাঙ্গালী মেয়েদের তুলনায় লম্বা। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিল ভাগ্নিটি। হাসুইবুর শ্বশুর বাড়ী দাসপাড়া। ভাঁটিতে হলে ও আমাদের উজানের গ্রাম রঘুনন্দন পাহাড়ের প্রায় লাগোয়া রতনপুর থেকে দু মাইলের বেশী হবেনা। তবে, এইযে ভাঁটি এলাকা! অজস্র কাঁদা পানি , আঁকাবাঁকা আইল , বাঁশের সাকো , খাল বিল পেরিয়ে বু’র বাড়ী যাওয়া কষ্টের হলে ও মা’র সাথে চলে যেতাম। খোদেজাকে সাথে করে প্রায় সময়ই দিনে দিনে চলে আসতে হত। বড় ভাই বাইরে চাকরি করেন। বাড়ীতে ভাবী একা যদিও ছোট মা , কাজের লোকেরা আছেন কিন্ত মা স্বস্তি পেতেন না। ছোটমা একগাদা ছেলেমেয়ে রেখে ছাগল, মোরগ আগলিয়ে ঘরে তুলতে পারতেন না। সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়ী ফিরে মা তাঁর ছাগল , মুরগ- মুরগি সামলিয়ে আমাদের দিকে নজর দিতে পারতেন। ততক্ষণে আমরা পাঁচ বোন, আমি ও খোদেজা মিলে লুকুচুরি খেলা , পুকুরে ঝাপিয়ে সাঁতার ইত্যাদি পর্ব শেষ। সাঁতারের সময় আমার এক বড় বোনের উপর দায়িত্ব ছিল আমাকে আলগিয়ে রাখা কারণ খেলা’বু সাঁতার শেখানোর পর ও আমার পারঙ্গমতা নিয়ে মা সন্দেহ পোষণ করতেন। খেলাবু কাছে না থাকলে আমার বছর দুয়েকের বোনই আমাকে দেখার কাজটি করতেন। আমি যখন সিলেটে পল্লীউন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বা আরডিটিআইতে পরিচালক তখন খবর পাই আমার বোনটি মারা গেছেন। এসে দাফনে শামিল হতে পেরিছিলাম। খেলাবু ও বেঁচে নেই। আজ খোদেজা, যাকে আমি লালমাই (গাঁয়ের রং খুব ফর্সা ছিল এ জন্য বোধ করি)বলে ডাকতাম তিনি ও চলে গেলেন। খুব অভাগা মনে হচ্ছে নিজেকে।
খোদেজা তাঁর জীবনে বড় বড় আঘাত পেয়েছে। এক মেয়ে ও পাঁচ ছেলের মা খোদেজা স্বামী শামসু’কে হারানোর পর ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টির কমতি চোখে পড়েনি। শামসুর ভাল নাম শমসের আলী। একাত্তরের এপ্রিল মাসে দুই বড় ভাইকে পাক বাহিনীর বর্বরতায় হারায়। নিজে পায়ে গুলি খেয়ে ও কোনরকমে বেঁচে যায় তবে পাক পিশাচদের নির্দয় মারধরে পরবর্তী তেইশ বছর বেঁচে থাকাটা বড় কষ্টের ছিল। খোদেজা প্রাণপণ সেবা করেছে। ঘটনাটি আমার বড় ভাই ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন তাঁর লেখা ‘প্রথম দর্শনে বঙ্গবন্ধু‘ গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “ একাত্তরের এপ্রিল। জোহরের নামাজের জন্য দক্ষিণ সুরমা গ্রামের মুসাল্লিগণ গ্রামের পুরনো মসজিদে সমবেত। হঠাৎ ডাকাত পড়ার মত বর্বর বাহিনীর আক্রমণ। মসজিদ থেকে গুনেগুনে গুফরালি, শমসের আলী, ইউসুফ আলীসহ প্রায় পনের-ষোল জন জোয়ান লোককে গুফরালীর ঘরে ঢুকান হলো। দেওয়া হলো তালা। বন্দীদের মাথায় তখনো টুপি, মুখে আল্লাহ রসুলের নাম। কিন্তু মুসলিম নামধারী পাকিস্তানী হানাদাররা ঐ ঘরে আগুন দিলো। আগুণের উত্তাপ ও তেজ যত বাড়ছে ততই ভিতর থেকে ভেড়া ভেঙ্গে প্রাণ বাচানোর দায়ে বের হয়ে আসেন গুফরালী , শমসের আলী, , ইউসুফ আলীসহ অনেকেই। হায়েনাদের বিকৃত মানসিকতায় তখন রক্তপিপাসা। গুলি চালাতে থাকে। শাহাদাত বরণ করেন চার–পাঁচজন সঙ্গেসঙ্গে। তাঁর মধ্যে অন্যতম ইউসুফ আলী জার কাছে পাওয়া যায় মুক্তিফৌজের কিছু খরচপত্রের হিসাব ও রসিদ বই। শমসের আলীর পায়ে লাগে গুলি। আঘাত সামান্য। কিন্তু বর্বর বাহিনী চালায় তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতন। হাত ও পায়ের সংযোগস্তলগুলোতে আঘাতে আঘাতে মুমূর্ষ করে ফেলে শমসের আলীকে। ’৯৫ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তেইশ বছর যাবত শমসের আলী এক জিবস্মত করুণ জীবনযাপন করে”।
আমার ভাইয়ের বর্ণিত কাহিনীতে আইয়ুব আলী যার কাছে মুক্তি বাহিনীর একটি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল সে কথা আসেনি। শমসের আলী যে সন্তানসম্ভবা পত্নীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে বাড়ী ফেরার পথে ব্রিজের নীচে পাক আর্মির হাতে ধরা পরে গুলি খেয়েছিল এবং মরে না যাওয়ার অপরাধে বুট নিষ্পেষিত হয়েছিল ষে কথাগুলো আসেনি। সব শেষে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এহেন হাজার হাজার গুফুরালীর অবদানকে স্বীকৃতিদানের কথা ভাবছে কি” ? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু এলাকার সম্মানিত সংসদ সদস্য, নামীদামী আমলারা দক্ষিণ সুরমা বা গোয়াছনগরের গুফরালীদের স্মৃতি সংরক্ষণে কি ই বা করেছেন ? মাধবপুরের আপামর জনসাধারণের প্রিয়পাত্র মাননীয় সংসদ সদস্য মৌলানা আসাদ আলী (বর্তমানে মরহুম)এ ব্যাপারে কিছুই করেননি। তাঁর ছেলে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও আজতক কিছু করেননি। রাস্তা, স্কুল ভবন বা গ্রামটির এতসব শাহীদদের স্মরণে স্তম্ভজাতীয় কিছুই কি তারা করতে পারতেন না ? ড. ফরাসউদ্দিন ও তো বঙ্গবন্ধু’র পি.এস ছিলেন ; তাঁর কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ও ঘনিষটজন ছিলেন। তিনি উদ্যোগ নিলে ও সম্মানজনক কিছু একটা করা যেত নিশ্চয়। আফসোস , ক্ষমতাবানরা কেউ কিছুই করেননি খোদেজা’র পিতা মরহুম মৌলানা হাফিজ উদ্দিন একজন সৎ ও ধার্মিক মক্তব শিক্ষক ও দাসপাড়া মসজিদের আজীবন ইমাম হিসাবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। ভারত বিভাগ আন্দোলনে, বিশেষত রেফারেনডামে তাঁর সক্রিয় অবদান ও জোরালো অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন আনোয়ার হোসাইন চৌধুরী ঢাকাস্থ মাধবপুর উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সংসদ প্রণীত ও মোঃ ওবায়দুল্লাহ সম্পাদিত মাধবপুর ডাইরেক্টরী গ্রন্থে (পৃষ্টা ১৪৮)। খোদেজার আম্মা (মরহুমা) আলম তারা (আমার হাসু’ বু) খুব সুন্দর চেহারার আধিকারী ছিলেন। লেখাপড়ায় ও খুব ভাল ছিলেন। সে সময়ের সামাজিক প্রথানুযায়ী অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পঞ্চম শ্রেণীর পর লেখাপড়া আর এগোয়নি।
খোদেজা আমার বর বোনের প্রথম সন্তান। শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারে সে খুব সুন্দরভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ঘরসংসার করছিল। স্বামী শমসু খুবই কর্মট মানুষ ছিল। বড় ভাই গফুর আলী (আমার ভাইয়ের জবানিতে “গুফরালি”) অবিভাবক হিসেবে ছিলেন তুলনাহীন। সমাজসেবা ও গ্রাম্য সর্দারীর পাশাপাশি ছোট তিনভাইকে ঘরসংসারের কাজে সবসময় সাহায্য করতেন। ঘরের চার বউকে চার বোন মনে হত। ১৯৭১’র ঘটনা তাদের সুখের সংসারে যে বিপর্যয় নিয়ে আসে তারই পরমপরায়ই বুঝি খোদেজা স্বামী, তিন জোয়ান ছেলে ও একমাত্র মেয়ে আয়েশাকে হারায় নিজের জিবদ্দশায়। একজন স্বামীঅন্ত পত্নী , স্নেহশীলা জননীর জন্য এর অধিক দুঃখের আর কি ই বা হতে পারে?
Posted ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh