মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

নশ্বর ও অবিনশ্বর : আমার দেখা শফিক ও তাঁর সংগঠন আশা

ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ   |   বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নশ্বর ও অবিনশ্বর : আমার দেখা শফিক ও তাঁর সংগঠন আশা

হ্যাঁ , আমি ‘আশা’ (ASA – Association for Social Advancement) নামে দেশে বিদেশে বহুল পরিচিত বেসরকারি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শফিকুল হক চৌধুরী’র কথা বলছি । একবুক কষ্ট আর অফুরান সুখ স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসেছি। আমার প্রিয় শফিক ৭২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতলে গত পাঁচদিন পূর্বে মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁকে আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে ১৯৬০ সাল থেকে চিনতাম। আমরা একই স্কুলে (হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) পড়াশোনা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও একই বিষয়ে (সমাজবিজ্ঞান) পড়াশোনা। আমি এক বছর সিনিয়র হওয়ার সুবাদে সবসময়েই তাঁর কাছ থেকে সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছি। আমার এ কনিষ্ঠের চিরতরে চলে যাওয়াটা বড় বেশী বেদনাদায়ক।

বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের এনজিও সমূহের গর্বিত উদাহরণ বাংলদেশের দু’জন প্রথিতযশা ব্যাক্তিত্ব স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও শফিকুল হক চৌধুরী (উল্লেখ্য, তাদের বাড়ী ও একই জেলায়- হবিগঞ্জে) অল্প সময়ের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করলেন। মূলত, পল্লী এলাকায় দারিদ্র বিমোচনের মহান লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে এনজিও হিসেবে আশা বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে গ্রামোন্নয়নের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাঠে নামে। শফিকের সুবিধা ছিলো। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ও সিসিডিবি’তে প্রশিক্ষক ও ম্যানেজমেন্টে কাজ করার সুবাদে পল্লি উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে ভাল ওয়াকেফাল ছিলেন। দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর শফিক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ও গ্রামোন্নয়নের ঝুঁকিপূর্ণ ফিল্ডে থেকে যান। আশা ও আশাই (আশা ইন্টারন্যাশনাল )প্রমাণ করবে নশ্বর শফিক পৃথিবীতে নেই সত্যি কিন্তু তাঁর সৃষ্ট সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি অবিনশ্বর হয়ে অগণিত মানুষের মনে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন।


বেসরকারি সংগঠন ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাক যাত্রা আগে শুরু করলে ও ১৯৭৮ সালে মানিকগঞ্জের তেপরায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে গ্রামোন্নয়নের প্রচেষ্টায় নেমে বাংলাদেশের কয়েক হাজারের ও বেশী এনজিওদের মধ্য থেকে আশা বাংলাদেশে তো বটেই, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে মাইক্রো ফাইনান্স ক্রেডিট কর্মসূচী হিসেবে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। বর্তমান সময়ে আশা বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ এনজিও হিসেবে স্বীকৃত। সংগঠনটির ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী যে সমস্ত উৎপাদনশীল ও সেবা প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে সঞ্চয়, ইনসিওরেন্স, কৃষি সংপৃক্ত ব্যবসা ও তথ্য প্রযুক্তি সেক্টর উল্লেখযোগ্য । তাছাড়া , বিনা মূল্যে জটিল ও ছোঁয়াচে রোগের রোগীদের চিকিৎসা সেবায় ও প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর রয়েছে। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগে ও ‘আশা’র স্বাস্থ্য মিশন অনুসরণ করে শফিকুল হক চৌধুরী তাঁর জন্মস্থান নরপতি (চুনারুঘাট উপজেলা, হবিগঞ্জ) গ্রামে একটি আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, বয়স্কদের জন্য নিবাস, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র, কম্পিউটার, এমনকি রেমিটেন্স ট্রেনিং ইত্যাদি সম্বলিত মনোরম কমপ্লেক্স তৈরি করে গেছেন। সবই গ্রামের গরীব অসহায় নারী -পুরুষদের জন্য। শিক্ষা ক্ষেত্রে ২০০৭ সালে “আশা’ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে মডেল হিসেবে বেশ ভালভাবেই ঠিকে আছে। বর্তমানে চার হাজারের ও অধিক ছাত্রছাত্রী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশুনা করছে।

২০১৫ সালে একটি সীমিত পরিধির গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আশা ২০১৪-১৫ ১২,০০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছিল। তখন বার্ষিক ৯৬.৭২ মিলিয়ন ডলারের বাজেট নিয়ে সংগঠনটি দেশের ৫১১ টি উপজেলার ৬৩,৮৩৭ টি গ্রামে কাজ করত । জনবল ছিল ২১,৪৭৭।


মানিকগঞ্জের একটি অনুন্নত অবহেলিত গ্রামে ১৯৭৮ সালে শুরু করা কার্যক্রম ধাপে ধাপে প্রসারিত হয়ে আজ দেশের ৬৪ টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্রাঞ্চ অফিসের এবং ২৪০০০ প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে ৫৫ লক্ষ নিন্ম আয়ের নারী – পুরুষদের নিরন্তর সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সদস্যদের আইনী সাহায্য প্রদান , সচেতন করার জন্য নিত্য প্রশিক্ষণ , ঋণ ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান ইত্যাদি নিয়মিত কাজের অনুষঙ্গ হিসেবে অবহিতকরন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করে যা বাংলাদেশর প্রেক্ষিতে আশির দশকের শুরুতে যুগান্তকারী তো ছিলই, এখন ও প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এ নেতা দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব দূরীকরণে বাস্তবতাকে কখনো পাশ কাটিয়ে যান নি । জুতসই কর্মসূচী গ্রহণে সবসময় উদগ্রীব থাকতেন ; সময়োচিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতেন তাঁর কর্মী বাহিনী ও সুফল ভোগীদের সাথে নিরন্তর আলাপ-আলোচনা , তাদের অংশগ্রহনের মাধ্যমে।

বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ‘আশা’ উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল সেই ২০০১ সালেই। এ নিয়ে আমার ‘ বাংলাদেশ পরিবেশ সমস্যা ও এনজিও’র ভূমিকা ‘শীর্ষক একটি প্রবন্ধে (উপ-সম্পাদকীয়, সাপ্তাহিক বাংলদেশ, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৫, নিউ ইয়র্ক) উল্লেখ্য করেছিলাম যে কিছু কিছু এনজিও ইতিমধ্যেই বিদেশী সাহায্য সংস্থা, দাতা সংস্থা ও বিদেশী এনজিওদের উপর আর্থিক ব্যাপারে তাদের নির্ভরশীলতা অনেকটা কমিয়ে ফেলেছে। এক্ষেত্রে ব্র্যাক ও আশা’র সাফল্য অনেক বেশী । আশা ২০০১ সাল থেকে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে বলে দাবি করে এবং দাতা সংগঠনরদের কাছ থেকে অনুদান নিচ্ছে না। বাংলাদেশে আশা’র কার্যক্রম সংগঠনটি নিজস্ব অর্থ ও সদস্যদের সঞ্চয় থেকে পরিচালনা করছে। তবে, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ/অনুদান নেয়া এখনো অব্যাহত আছে বলে জানা যায় ।


আশা ২০০৭ সালে মাইক্রো ফাইনান্স কর্মসূচী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে (১৩ টি দেশে) “আশা ইন্টারন্যাশনাল’ (মরিশাসে রেজিস্ট্রিকৃত) নামে পরিচালনা করে আসছে। এ কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে ঘানা, ইন্ডিয়া, কেনিয়া, মায়ানমার, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইনস, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওন, শ্রীলঙ্কা, তাঞ্জানিয়া , উগান্ডা ও জাম্বিয়া । নেদারল্যান্ডের একটি ইকুয়িটি সংস্থা (সিএমআই) আশা ইন্টারন্যাশনালকে তহবিলের যোগান দিচ্ছে। প্রায় ১ বিলিয়ন গরীব মহিলা যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে তা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের প্রয়াস নিতে আগ্রহী তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আশাই কর্মসূচী থেকে সুফল ভোগকারীদের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করার হার অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ঋণ প্রদান ও পরিশোধ সংক্রাত বিষয়ে শফিক চৌধুরী’র নিয়মানুবর্তিতা ও অন্যান্য মূল্যবোধ সম্পর্কে ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ তারিখের দি ডেইলি স্টার পত্রিকা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের বিগত ত্রৈমাসিক রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে তাঁকে এসব ব্যাপারে হেনরি ফোর্ডের সাথে তুলনা করা যায়।

পূর্বেই উল্লেখ্য করেছি যে শাফিক অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন । আমার সাথে সর্বশেষ দেখা পাঁচ বছর আগে। যেদিন ফোন করি বলেছিলেন যে পরের দিনই ভারতে যাচ্ছেন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে। কথা প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করেছিলেন , তিনি আশা ম্যানেজমেন্টের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর এ ইঙ্গিত যে লোকান্তরিত হওয়ার তা আমি সেদিন ও কল্পনা করিনি। অত্যন্ত তেজস্বী স্বভাবের, সঙ্কল্পে, প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়চেতা, স্বচ্ছ মিশন ও ভিসন অর্জনে সদা প্রস্তত আপোষহীন মানুষটিকে বড্ড মিস করবো। দেশেবিদেশের লাখোলাখো মানুষের সাথে আমি ও একজন নিঃস্বার্থ, মানবতাবাদী, সাধারণ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী এবং অত্যন্ত দরদী মনের শফিকুল হক চৌধুরীকে হারিয়েছি। তিনি আমাদের মাঝে নেই এ কথা ভাবতে ও দারুণ কষ্ট হয়। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তে স্থান দিন- এ দোয়া করি ।

advertisement

Posted ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6091 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1286 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1142 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.