ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | শুক্রবার, ০৭ আগস্ট ২০২০
আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর পূর্বে মিসিসিপিতে একটি খুনের ঘটনা ঘটে। তারিখটি ছিল ১৯৫৫ সালের ২৮শে আগস্ট। ইমেট টিল নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়। শে সময় যুক্তরাষ্ট্রে কালো বর্ণের লোকজনদের সামান্য কারণে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করা, ফাঁসিতে ঝুলানো, গুলি করে কিংবা পিটিয়ে হত্যা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার ছিল। এ জন্য শ্বেতাঙ্গদের শাস্তি হতোনা, এমনকি প্রতিবাদ ও না। জিম ক্রো’র আমেরিকার এহেন প্রতিচ্ছায়ায় ও ইমেট টিলের মা’কে প্রতিবাদের রাস্তা আবলম্বন থেকে ফেরাতে পারেনি। ম্যামি টিল মোবলি ছিলেন অসম সাহসী অসাধারণ এক মহিলা। অকুতোভয় ম্যামি মোবলি ছেলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ কফিনে তোলার পর ও এ নির্দয়, অকারণে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডটি মেনে নিতে পারছিলেন না। সারা বিশ্ব দেখুক তাঁর নিরাপরাধ ছেলেকে নির্মমতার সাথে হত্যা করা হয়েছে। এ মর্মজ্বালা সামান্য মাত্রায় হলে ও নিরসনের জন্য তিনি ছেলের প্রাণহীন দেহের উন্মুক্ত ক্যাসকেটে রাখা অবস্হায় ছবি তুলেন। ‘জেট’ ম্যাগাজিন থেকে ছবিটি বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। সারা দুনিয়া দেখে তাঁর প্রাণপ্রিয় ছেলেকে কি নৃশংসহ ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ছবি ও ঘটনার বর্ণনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় সিভিল রাইট মুভমেন্ট এর শুভসূচনা শুরু হয়। ছাত্র , জনতা, শ্রমিক, খেলোয়াড়, যুব সম্প্রদায় এরা সবাই আন্দোলনে যোগ দেয়। ইমেটের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে মারটিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর “আই হেভ এ ড্রিম” শীর্ষক কালজয়ী বক্তৃতা প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে আসেন এবং নিজে ও আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্টের অভিবাংসিত নেতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
বিগত মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটে। পুলিশর গুলিতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ আহমাউদ আরবেরী, ব্রেউনা টেইলর, এবং জর্জ ফ্লয়েড ম্যারা গেলে সারা দেশে, বিশেষত বড়ো বড়ো শহরে জনতা ফুঁসে উঠে। জনতার এ রোষ শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত চলতে থাকা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ, মূলত পুলিশ বাহিনীর শ্বেতাঙ্গ সদ্যসদ্যের উপর। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের দাবীতে আহুত ধর্মঘট ও হরতালে ব্যাপক লুটতরাজ ও সহিংস ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। আনেক সময় শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ ও অহিংস মিছিল করতে গিয়ে বেদরক মার খায় পুলিশের হাতে। সাধারণ জনগণের, বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকানদের এমনতরো রোষের যথেষ্ট কারণ আছে। পুঞ্জিভূত রোষ এ করোনা সময়ে, চরম অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে আছড়ে পড়ে পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে। হোয়াইট হাউজ, বিচার বিভাগ, ফেডারেল সরকার সহ স্থানীয় সরকার প্রশাসনের উপর তাদের রাগ চরমে কারণ যুগ যুগ ধরে তারা শিক্ষাদীক্ষা, চাকরী-বাকরী ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়েছে। সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদের অসম বণ্ঠন ব্যবস্থা ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যকে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও পীড়াদায়ক অবস্থানে নিপতিত করেছে। দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাজনে ১% ধনিক গোষ্ঠীর হাতে সম্পদের ৯৯%। এজন্য অনেকে ব্যঙ্গ করে আমেরিকাকে শ্রেণিহীন সমাজ বলে। সত্যি কথা হলো, বিগত চল্লিশ বছর যাবত দেশের এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যার বা ২০% লোকের বেলায় সম্পদ বেড়েই চলেছে অবাধ গতিতে। ৮০% ভাগ্যের জন্য এ বৃদ্ধি অতি মন্থর। এ বিভাজনে শ্বেতাঙ্গরা সুবিধজনক অবস্থানে বলাইবাহুল্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। বর্ণবাদের অপআদর্শকে কেন্দ্র করে এ পৃথকীকরন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সীমাহীন বাঁধার কারণ ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণে এ শিক্ষা নিয়ে গর্ব করার মতো তেমন কিছু তারা আহরণ করতে পারেনি। পিছিয়ে থাকায় জন্ম নেয়া মানসিক দৈন্যতা অদ্যাবদি আফ্রিকান-আমেরিকান ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিদ্যমান যদি ও মেধার দিক থেকে তারা অন্যদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়।
কোভিড-১৯ সময়ের বিগত পাঁচ মাস অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে তাদেরকে দারুণভাবে পর্যুদস্ত করেছে। এমনিতেই বেকারত্বের হার তাদের মধ্যে অনেক বেশী। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়। বাড়ী কেনা, ভাড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো বটেই, প্রতিদিনের চলাফেরা, গাড়ী চালানো এসব কর্মকাণ্ডে ও পুলিশ ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত পুলিশের ঝামেলা পোহাতে হয় অনেক বেশী। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে মোট জন সংখ্যার মাত্র ১২% হলেও ফেডারেল প্রিজনের ৩৩% কয়েদী আফ্রিকান-আমেরিকান ; শ্বেতাঙ্গরা মোট জনসংখ্যার ৬৪% হলেও এদের কয়েদীর হার ৩০%। কৃষ্ণ বর্ণের যারা তারা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে গড়ে ৩.৫ বছর কম বেঁচে থাকে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের এবং মৃত্যুর হার অর্থনৈতিক ভাবে দীনহীন যারা তাদের হোয়াইটদের তুলনায় অনেক বেশই। এরা আক্রান্ত হলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। দীর্ঘদিনের বর্ণ বৈষম্য, বেকারত্ব, দুর্বল স্বাস্থ্য সেবা, আয়ের ক্ষেত্রে নিন্মমুখিতা, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা এসব কারণের সাথে কো-১৯ প্যানডেমিক, বেকারত্ব এবং জনতার রোষ -এ ত্রিবিদ কার্যকারণ মিলে আজকের আমেরিকা নিশ্চয়ই এক সমস্যাসঙ্কুল সমাজ, অর্থনৈতিক সত্তা এবং বিপন্ন রাষ্ট্র।
Posted ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৭ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh