শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

করোনার সময়ে এবং পরে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী   |   বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০

করোনার সময়ে এবং পরে

আমরা এখন আটক আছি ভয়াবহ এক অস্বাভাবিকতার ভেতরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন সমাজকে আক্রমণ করেছিল, এবার তেমনি এক আঘাত এসেছে করোনাভাইরাস থেকে। কেবল আমাদের সমাজকে নয়, সমগ্র বিশ্বকেই সে পর্যদুস্ত করতে চাইছে। এ এক বিশ্বযুদ্ধ, যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আগের দুটি বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়েছিল পুঁজিবাদি-সাম্রাজ্যবাদিরা, নিজেদের দখলদারিত্বের পরিমাণ বৃদ্ধির প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এবারকার আক্রমণটি এলো গোটা পুঁজিবাদি ব্যবস্থার ভেতর থেকেই। মানুষের সঙ্গে পুঁজিবাদের যে স্থায়ী শত্রুতা, তারই সর্বশেষ ও বিশ্বব্যাপী প্রকাশ ঘটেছে করোনার এই আক্রমণে। আগের দুই যুদ্ধের তুলনায় সে নিঃশব্দ, কিন্তু অনেক বেশি বিস্তৃত। এর আক্রমণ কেবল মানুষ করছে না, বিশ্বব্যাপী মনুষ্যত্বই বিপন্ন হয়েছে। মানুষের সভ্যতার যত অর্জন সমস্ত কিছুকে নাকচ করে দিয়ে করোনা মানুষকে তার আদিম অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, আদিম কালের মানুষের ভেতরেও পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং প্রকৃতীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল; এই মহামারী সেই দুই গুণকেও মুছে ফেলে দিতে চায়। বলে তুমি ঘরে থাকো, গুহায় ঢোকো। তুমি তোমার সামাজিক সত্তাটাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলো, কারও দিকে কোনো দিকে তাকিয়ো না; অন্যরা প্রত্যেকেই তোমার শত্রট্ট, তোমার জন্য তারা বিপদ বহন করছে। আত্মীয় নেই, স্বজন নেই, প্রত্যেকেই তার নিজের তরে।

কিন্তু মানুষের সভ্যতা তো গুহাবাসী নয়, ছিল না কখনো, হবে না কখনো; হলে তার মৃত্যু ঘটবে। সভ্যতা চায় মানুষ সামাজিক হোক, একত্র হোক, বিশ্বজুড়ে হাত ধরাধরি করে চলুক একে অপরের। সভ্যতার আকাক্সক্ষা রোগের আন্তর্জাতিকতায় নয়, স্বাস্থ্যের আন্তর্জাতিকতায়। এটা তো জানাই আছে যে রোগের সংক্রমণ খুবই সহজ, স্বাস্থ্যের বিস্তার অত্যন্ত দূরূহ। মানুষের সভ্যতা সহজের নয়, দূরূহের সাধনাই করে। মানুষের ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার কর্তব্য। করোনার কাজটা ঠিক উল্টো। করোনা হচ্ছে বিধ্বংসী, সভ্যতা সৃজনশীল। করোনা বিচ্ছিন্ন করে, সভ্যতা করে সংলগ্ন। পরিষ্কার ভাবেই দেখা যাচ্ছে যে সভ্যতা এবং করোনা পরস্পরবিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। করোনার অন্তর্ধান মানুষের সভ্যতার জন্য নিজের কর্তব্যপালনের প্রধান শর্ত।


করোনা পরাস্ত হবে। মানুষ কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি, করবে না এবারও। ওষুধ আবিষ্কৃত হবে, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। কিন্তু আগামীতে যে নতুন কোনো এবং আর ভয়াবহ কোনো মহামারী দেখা দেবে না তার নিশ্চয়তা কী? নিশ্চয়তা মোটেই নেই; বরং আশঙ্কা আছে। সেটা যাতে না ঘটে সভ্যতার কাজ ঠিক সেইখানটিতেই। তার জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করা, মনুষ্যত্বকে আরও বিকশিত করে তোলা। ধ্বংসের হাত থেকে তাকে বাঁচানো। মানুষের জ্ঞানচর্চা সেই সত্যটাকেই সামনে নিয়ে আসবে করোনার ধ্বংসলীলা যাকে ধরিয়ে দিল। আসামি করল। সেই সত্যটা হলো এই যে, যাকে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম তার অন্তরালে দারুণ অস্বাভাবিকতা ছিল। সেটি হলো কৃত্রিমতার। বলা চলে মানবিকতার উন্নতির নামে অমানবিকতার চর্চা চলছিল। বাড়ছিল ধনবৈষম্য এবং প্রকৃতীর সঙ্গে মানুষের শত্রুতা। বৈষয়িক উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু যত উন্নতি হয়েছে তত বেড়েছে ওই দুই দুর্বলতা। পুঁজিবাদি উন্নতির প্রধান নিরিখ দাঁড়িয়েছে মারণাস্ত্র আবিষ্কার। এই উন্নতি মানুষকে নিরাপত্তা দেয়নি, দেবে না। বরং তাকে আরও বেশি অনিরাপদ করে তুলবে এবং তুলেছে।

করোনায় বৈষম্য বাড়বে। অসংখ্য মানুষ বেকার হবে। ভুগবে ক্ষুধায়। দরিদ্র দেশগুলো আরও দরিদ্র হবে, দরিদ্র মানুষের জীবনমান আরও নিচে নেমে যাবে। বৃদ্ধি পাবে সহিংসতা। ওদিকে সভ্যতা বলে মনুষ্যত্বের প্রমাণ হিংস্রতায় নেই, নেই মানুষকে মারার ও তার মনুষ্যত্বকে হরণ করার ভেতরে; আছে বিশ্বব্যাপী সুখ ও প্রাচুর্য বৃদ্ধিতে। মানুষে-মানুষে এবং মানুষে-প্রকৃতীতে মৈত্রী যদি এগোয় তবেই সভ্যতা এগুবে, নইলে প্রলয় অনিবার্য। তাতে মানুষের সভ্যতা কেবল নয়, মানুষের অস্তিত্বই বিপদগ্রস্ত হবে।


পৃথিবীটাকে তাই বদলানো চাই। বদলানোর কাজে সবচেয়ে কার্যকর ও উপকারী অস্ত্র হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানই পারে শক্তি জোগাতে, ক্ষমতা দিতে। আজ সেই জ্ঞান খুব বেশি দরকার যে বলে দেবে যে একা কেউ বাঁচতে পারে না, বাঁচতে হলে মিলতে হবে। আর মিলনের প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানা। করোনা পুঁজিবাদের ফসল ও প্রতিনিধি। ব্যক্তিকে সে একমাত্র সত্য করে তুলতে চায়, সমষ্টিকে ভুলিয়ে দিয়ে। করোনা জানিয়ে দিচ্ছে যে সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া বর্তমান পৃথিবীর জন্য মুক্তির অন্য কোনো উপায় নেই। করোনা সামাজিক দূরত্ব তৈরি করছে, করোনাকে এবং তার উৎপত্তিস্থলকে বিনষ্ট করতে হলে সমষ্টিগত উদ্যোগ দরকার। সেই উদ্যোগের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা। ব্যক্তিমালিকানা যা দেওয়ার ইতোমধ্যেই দিয়ে ফেলেছে, বাকি আছে প্রলয় সৃষ্টি করা। এই উপলব্ধিটা আজ জেগে উঠছে প্রত্যেকটি দেশে, এবং সারা বিশ্বে। বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষা এখন তেমন সামাজিক মালিকানার যা দেয়ালগুলো সব ভেঙে ফেলবে, বিশ্বকে করবে বিশ্বজনীন। বলাইবাহুল্য যে, সেই উপলব্ধিটাই হচ্ছে মানবজাতির প্রধান ভরসা।

জ্ঞানের চর্চা বিলাসিতা নয়; সে হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয়। তার চর্চাই পারে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে এবং মুক্তির জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। সে সৃষ্টি করতে চায় আন্তর্জাতিক সামাজিকতা। জ্ঞানের এই চর্চা মানুষের সভ্যতা তৈরি করেছে, সেখানেই তার গৌরব ও চরিতার্থতা। জ্ঞানের এই চর্চা অব্যাহত থাকা চাই। জ্ঞানের এই চর্চাই মানুষের সভ্যতাকে বিকশিত করছে। সেখানেই তার চরিতার্থতা। এটা এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গোটা সমাজের। বিশেষ করে তাদের যারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে নিতে চান না। করোনাভাইরাস বলে দিল যে সমাজ পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন দরকার এবং সেই আন্দোলনের জন্য জ্ঞানের চর্চা অত্যাবশ্যকীয়। জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকুক।


ভুললে চলবে না যে করোনাভাইরাস একটি রোগ বটে; একশ বছর আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্প্যানিশ ফ্লুর যে তাণ্ডব দেখা দিয়েছিল এর তৎপরতা তারচেয়েও বেশি ব্যাপ্ত। এই ভয়াবহ রোগ আরও বেশি ভয়ংকর। এটা একটি রোগ থেকে উৎকীর্ণ। সেই রোগের নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ মুনাফা চেনে, মনুষ্যত্ব চেনে না। পুঁজিবাদ ভোগ-বিলাসিতাকে অতিমাত্রায় পছন্দ করে। প্রত্যাখ্যান করে সংবেদনশীলতাকে। তার নৃশংসতা প্রকাশ পায় প্রকৃতীর সঙ্গে শত্রুতার। একদিকে সে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে, অন্যদিকে মানুষকে সভ্য করার ভান করে চর্চা চালায় আদিম বর্বরতার। আদিম কালেও মানুষের সঙ্গে প্রকৃতীর সম্পর্কের ভেতরে যে সংবেদনশীলতা ছিল, পুঁজিবাদ তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। এক সময়ে তার ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল। কিন্তু করোনাভাইরাস উপহার দিয়ে সে প্রমাণ করে দিল পুঁজিবাদ নিজেই একটি ব্যাধি। বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস মানুষের সৃষ্টি নয়, প্রকৃতী থেকে এসেছে। মানুষ একে সৃষ্টি করেনি ঠিকই কিন্তু কিছু মানুষের পুঁজিবাদি তৎপরতাই তাকে তৈরি করে দিয়েছে। প্রকৃতীর ওপর মানুষের নিপীড়নের ফল হলো এই রোগ।

করোনার বিরুদ্ধে, এবং তার উৎস যে পুঁজিবাদ তার বিরুদ্ধে নতুন এক আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজন। সেই আন্তর্জাতিকতা বিশ্বায়নের নয়। বিশ্বায়নের আন্তর্জাতিকতা বাণিজ্যিক, পুঁজিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতা বাণিজ্যিক নয়, মানবিক। মানবিক এই আন্তর্জাতিকতার জন্য প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের। প্রত্যেকটি দেশে এবং সারা বিশ্বে সামাজিক বিপ্লব ব্যক্তিমালিকানার পৃথিবীটাকে বদলে দিয়ে সামাজিক মালিকানার নতুন জগৎ প্রতিষ্ঠা করবে। তা না হলে ব্যাধিতে বিপন্ন এই পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের উপযোগী থাকবে না।

পৃথিবীকে বদলাবার কাজে প্রধান প্রতিবন্ধক হবে বিশ্ব পুঁজিবাদি ব্যবস্থা এবং তার অধীনে প্রত্যেকটি দেশের সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণি। লড়াইটা তাই হয়ে দাঁড়াবে প্রতিটি দেশের এবং সারা বিশ্বের শাসিতরা লড়বে শাসকদের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতা থাকবে, অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান করবে; কিন্তু কোনো একক বিশ্ব নেতৃত্ব থাকবে না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

advertisement

Posted ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6285 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1306 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1151 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.