মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ | বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২১
এই লেখা যখন লিখছি, আমার সহকর্মী সাঈদ তখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। সাথে তার স্ত্রী সন্তানেরা সবাই করোনায় আক্রান্ত, তারাও হাসপাতালে। সাঈদের করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন শুনে আমার কান্না পেল। হায়! সাঈদের এত কষ্ট, আমরা কেন জানি না। আমরা এত সুন্দরভাবে আছি, সাঈদ কেন নেই। সাঈদ আর আমি এক সাথে এক জায়গায় কাজ করতাম। আমরা সবাই ঠাট্টা মশকরা করতাম কাজে এসে। এমন বন্ধুদের পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। আজ আমার সাঈদ তার পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, আমি তা হলে কই। আমার প্রাণের কষ্ট আর মানে না। এ কেমন রোগ তাকে একটু ছুঁতে পারিনা। আমার অন্য সহকর্মী তুলি, পারভেজ, সামসুল, সিদ্দিক সবাই কাজে এসে আগের মতো আর হাসে না। করোনা কখন কার প্রাণ কেড়ে নেয়। সেই আতঙ্কে সবাই।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে চার লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা গেছে আমেরিকায়। আরো কত মরতে চলেছে। কেউ জানে না কার কপালে কি আছে। প্রতিদিন করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে ৪০০০ হাজার মানুষ মারা যায় আমেরিকায়। এরপর কি হবে কেউ কিছু জানি না। নূতন বছর পৃথিবীর মানুষদের কোথায় নিয়ে যায়, তা বলা সম্ভব নয়। নতুন বছরে কভিড-নাইন্টিন আরো শক্তিশালী চেহারা নিয়ে আবির্ভাব হয়েছে। আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্ন দেশে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নতুন করে আছড়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে নিউইয়র্কে বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরেও। এখানে ঘরে ঘরে বাংলাদেশীরা আজ আক্রান্ত। একজন থেকে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকের শরীরে। সেই কারণে ভালো থাকার স্বপ্ন আর দেখতে পারি না। তবুও সবাই সবার মঙ্গল কামনা করতে কার্পন্য করি না।করোনা মহামারীর হিংস্র ছোবল পৃথিবী থেকে মূল্যবান প্রাণগুলো কেড়ে নিয়েছে। আরো হয়তো নিবে। এর জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। এত মৃত্যু আমাদের কাম্য ছিল না। কবে পৃথিবী বিষাক্ত করোনার ছোবল থেকে মুক্তি পাবে।
আমরা যেন একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। এ কেমন বেঁচে থাকা। কি অদ্ভুত একটি অন্য রকম বছর পার করলাম আমরা। এ এক বেঁচে থাকার লড়াই। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ কেমন বাঁচা।
প্রাণঘাতী করোনা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। মানষিকভাবে নিস্তেজ করে দেয়। একে অপরের ভালোবাসা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। করোনা সম্পর্ককে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মানুষ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এও কি পারা যায়। মাস্ক পড়ার কারণে আপনজনকেও এখন চেনা দায়। আপন এখন পর হয়ে যায়। এভাবেই ভাবনার সীমাকে অতিক্রম করে চলেছি আমরা। এর শেষ কোথায় জানি না। আমাদের নিজেদের পূর্ণমিলন ঘটবে কখন জানি না। প্রিয়জন কতদূর চলে যায়। অসীম ধৈর্য নিয়ে ক্রমাগত নিত্যনতুন পরিস্থিতি সামলাতে হয়। তারপরেও বন্ধু তোমাকে প্রাণঢালা ভালোবাসা জানাই। তুমি ভালো থেকো। আমরা এ ভাবেই সকল শুভাকাঙ্খীকে সাথে নিয়ে সকল লড়াই জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
তারপরেও জীবন থেমে থাকে না। করোনাকাল অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। মানুষ জানতে পারছে কঠিন রোগ হলে মানুষ কাছে থাকে না। বিপদে পরলে বুঝা যায় কে আপন, কে পর। যাকে আপনি আপন ভাবছেন, সেই-ই আপনার সর্বনাশ করে দেয়। ১০০ বছর পরপর পৃথিবীতে বিপর্যয় হানা দেয়। ২০২০ সাল আমরা মোকাবিলা করেছি করোনা ভাইরাসে। কত অমূল্য জীবন ঝরে গেলো অকালে। সকলেই বাঁচতে চায়। কত প্রদীপ নিভে যায়। একই পরিবারের একের অধিক মানুষ মারা গেছে এই করোনায়। ফলে মানুষ মানুষের দিকে তাকাতে ভয় পায়। এর চেয়ে হৃদয় বিদারক কষ্টের যাতনা আর কি হতে পারে। মানুষ কতটা অসহায় হলে পরে এমন হয়। ২০২০ সাল ভয়াবহ ভাবে পার করলো বিশ্ববাসী। অসংখ্য মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারানো বছর। যে শিশু মাকে হারালো সে জানলো না মা কি জিনিস। যে শিশুরা বাবাকে হারালো, তারা বুঝল না বাবার নির্ভরতা কতটুকু। কভিড নাইন্টিন মানুষের মনকে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। দিয়েছে সারা জীবনের কান্না। মানুষের করুন দীর্ঘশ্বাসে চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পাই। আরো কত মানুষের জীবন ঝরে যাবে সে কষ্টটা থেকেই যায়। কেননা আবারও হাসপাতালে উপচেপড়া রোগীর ভীর।
আমেরিকাতে হাসপাতালে রোগী রাখার আর জায়গা নেই বলে নতুন করে হোটেলে রাখতে শুরু করেছে। সেখান থেকেই তাদের চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার নার্সরা প্রতিদিন বলছেন মাস্ক ব্যবহার করতে। আর দেশের প্রধান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন অন্য কথা। তার কারণে জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমেরিকায়। তা না হলে এমন উন্নত দেশে এত মানুষ মরবে কেন আমেরিকায়? তিনি নিজেকে ছাড়া দেশের মানুষের কথা ভাবেননি কোন। তার নিজের কাছে ছিল ক্ষমতা আর স্বার্থ। নিজের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও চিন্তা করেননি তিনি। আমেরিকার মতো এমন একটি গণতান্ত্রিক দেশকে তিনি কোথায় নামিয়েছেন। গত চার বছর আমেরিকাকে অশান্ত করে রেখেছিলেন। বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে বৈষম্য তৈরি করেছেন। সর্বোপরি করোনা মহামারীকে উপেক্ষা করে কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। গত ৬ই জানুয়ারির ঘটনার কারনে তিনি এখন বিশ্ব জুড়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। তাঁর নিজের লোকেরাও বয়কট করে চলেছে তাঁকে এখন। এমন ঘটনায় আমেরিকার রাজনৈতিক পুরোধা ব্যক্তিরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন সেটাই অবাক হবার বিষয়। এ ঘৃণিত ব্যক্তিকে কে দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে দুইবার ইম্পিচমেন্টের সন্মুখীন হয় যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
আমেরিকার আড়াইশ বছরের গণতন্ত্র চর্চার সূতিকাগার ক্যাপিটল হিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থক উগ্রপন্থী শেতাঙ্গবাদী মিলিশিয়াদের সেখানে লেলিয়ে দেন, কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল ভোট গণনা ও জো বাইডেন-কামালা হ্যারিসের অনুমোদনকে ভল্ডুল করে দিতে। সে দিনকার ক্যাপিটল হিলে সংঘটিত দাঙ্গায় দুইজন পুলিশ ও একজন নারীসহ ছয় জনের মৃত্যু হয়। ক্যাপিটল ভবনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের নজিরবিহীন সহিংস তান্ডব ও ভাংচুরের ঘটনায় বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছে গোটা বিশ্ব। তার উগ্রপন্থীরা দলে দলে ঢুকে পড়ে ভাঙ্গচুরের তান্ডব চালিয়ে আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি ঘটায়। এই ঘটনার পরিনাম সম্পর্কে এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না এই অদূরদর্শী ও অপরিনামদর্শী প্রেসিডেন্টকে। কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য, সর্বোপরি তার ভবিষ্যতের জন্য যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমেরিকার ইতিহাসে একজন কলঙ্কজনক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বিদায় নিতে হয়েছে।
Posted ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh