আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
ফারুকের মৃত্যুর পর ২৬ দিন পেরিয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক হোসাইন। গত ২৬ ডিসেম্বর মুম্বাই এর টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ফারুক ইন্তেকাল করেছে। এত দ্রুত সে চিরতরে চলে যাবে এমন ধারণা করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও আমার কাছে বাচ্চা ছেলে। দুই যুগ আগে ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে যশোরে ওদের বাড়িতে যখন পরিচয় হয়, তখন সে মাস্টার্স শেষ করেছে, কিন্তু ওকে দেখে মনে হতো স্কুলের শেষ দিকে বা সবে কলেজে পা দিয়েছে। পরিচয় ও সম্পর্কের সূত্র ওর বড় ভাই হারুন জামিল।
হারুনের বিয়ে উপলক্ষে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। হারুন ততোদিনে আমার পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিল, এখনও তাই আছে। খোঁজখবর নেয়ার জন্য হোক, কোনো প্রয়োজনে হোক, যখন তখন হারুনকে ফোন করি। ফারুকের সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ না আমার ফোন করার সময়ে সে হারুনের সঙ্গে থাকলে কথা হতো। শেষ কবে কথা হয়েছিল মনে নেই। ওর সঙ্গে কথা না হলেও হারুনের সঙ্গে যখনই কথা হয়েছে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবার ফারুকের প্রসঙ্গ এসেছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার আগে হারুনের বাসায় ওর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল, তখন সে সহকারী অধ্যাপক হয়েছে, তখন ওর স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। যখনই দেখা হতো হাসি-খুশি প্রাণবন্ত শিশুর মত কথা বলতো, যেন আমার কাছে ওর কোনো আবদার আছে। হাত ধরেই রাখতো।
২০১৯ এর কোনো এক সময়ে হারুনের কাছেই জানতে পারি ফারুকের গলায় সমস্যা হয়েছে। টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ফারুকের সঙ্গেও কথা হয়, সমস্যা সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছিল, তাতে মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারি। ওর ডাক্তাররা আশাবাদী চিকিৎসায় আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমে আমি ওর ভোকাল কর্ডে সিস্ট বা স্ফীতি ধরনের সমস্যা ভেবেছিলাম।
এ জন্য মুম্বাই পর্যন্ত কেন যেতে হলো সে প্রশ্নও করেছিলাম। কারণ ঢাকায় এ ধরনের সমস্যায় নিরাময়ে ইএনটি সার্জনরা ভালো করছেন বলে শুনেছি, তা না হলে নাগালের মধ্যেই কলকাতা আছে। সম্ভবত ওর সমস্যা আমি পুরোপুরি বুঝে ওঠতে পারিনি। আমি আমার নিজের ভোকাল কর্ডে সমস্যার মত ভেবেছিলাম, যে সমস্যা এখনও অনেক সময় অনুভব করি। শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে, যখন কথা বলার সময় আমার কণ্ঠস্বর একটু উঁচুতে ওঠলেই কয়েক সেকেণ্ডের জন্য কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যেতো। ইএনটি’র ডাক্তার সালাহউদ্দিন দেখে দ্রুত তাঁর শিক্ষক সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ইএনটি’র প্রফেসর আবদুল্লাহ’র কাছে পাঠান। তিনি পরদিন সার্জারির জন্য তাঁর চেম্বারে যেতে বলেন।
এসব বিষয় আমাকে তেমন উদ্বিগ্ন করে না। রাতে আমি স্ত্রীকে বলি কাল আমার ভোকাল কর্ডে সার্জারি হবে, কয়েক ঘন্টার ব্যাপার, সকালে আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য রেডি থেকো। সে হৈ চৈ বাঁধিয়ে। বাংলাদেশে এ ধরনের সার্জারিতে অনেক ঝুঁকি ইত্যাদি। খোঁজখবর না নিয়ে সার্জারি করতে দেবে না। আমাদের সুহৃদ ডাক্তার বন্ধু বুলবুল সরওয়ারকে ফোন করে। ডা: বুলবুল জানান, এ সমস্যা তারও হয়েছিল, কলকাতায় সিএমআরআই (ক্যালকাটা মেডিকেল রিসার্চ ইন্সটিটিউট) এ ডা: মিলন চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে সার্জারির পর সুস্থ হয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে মিলন চক্রবর্তীর ফোন নাম্বার, সার্জারির ব্যয় কত হতে পারে এসব তথ্য সংগ্রহ করে ডা: আবদুল্লাহর সার্জারির অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে। যাহোক, এরপর কলকাতায় গিয়ে সার্জারি করে আসি। বায়োপসি রিপোর্ট ‘বেনাইন’ বা ক্ষতিকর নয় আসে। বায়োপসি রিপোর্ট ‘মেলিগন্যান্ট’ বা ঘাতক হলেই চিকিৎসার মধ্যে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, সার্জারি ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হয়, বহু ধরনের ওষুধ সেবন করতে হয়।
ফারুকের ক্ষেত্রেও বায়োপসি রিপোর্ট এসেছিল ‘মেলিগন্যান্ট’ এবং কষ্টকর ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করতে হচ্ছিল। চিকিৎসার পর্যায়ে আরও একবার কথা হয়েছিল ফারুকের সঙ্গে। আশাবাদী ছিল সে। আমিও আশাবাদী ছিলাম যে ফারুক সেরে ওঠবে। তখন হয়তো সে জানতো না যে ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যান্সারের সঙ্গে অনেক বছর ধরে লড়ে ভালোভাবে টিকে আছেন, কর্মময় জীবন কাটাচ্ছেন এমন ক’জন ব্যক্তিকে কাছে থেকে দেখেছি। ফারুক তাদের একজন হতে পারতো, কিন্তু সম্ভাব্য ধরনের চিকিৎসার পর ফারুককে এত দ্রুত কেন হার মানতে হলো, তা আমাকে বিস্মিত ও স্তব্ধ করেছে। ফারুকের মৃত্যুর পর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমার পক্ষে হারুনকে ফোন করে সান্তনা জানানো সম্ভব হয়নি। দুই ভাইয়ের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক ছিল, তাতে ফারুকের মৃত্যুতে হারুনের নি:সঙ্গতা আমি অনুভব করতে পারি।
সবকিছু সত্বেও আমাদের শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হয়, আমরা মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, ঠেকিয়ে রাখতে পারি না। কোরআনে বলা হয়েছে: “কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মউত,” (প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে: আল-ইমরান, আয়াত ১৮৫)। যেভাবেই হোক মানুষকে মরতে হবেই। এই অধ্যায় থেকে কারও কোনো নিস্কৃতি নেই। মৃত্যু হঠাৎ আসে। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলেও বোঝা যায় তার মৃত্যু আসন্ন। অনেক সময় মৃত্যু কোনো আভাস না দিয়েই আসে। সেজন্য জীবনের চেয়ে সম্ভাব্য মৃত্যুর প্রতিফলন অনেক শক্তিশালী এবং সেজন্য আমাদের উচিত বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রাখা। হযরত আলী আমাদের এ পরামর্শই দিয়েছেন যে মৃত্যুকে মনের মধ্যে এমনভাবে রাখতে হবে যেন আজকের দিনটিই আমাদের জীবনের শেষ দিন; আবার একই সময়ে আমাদের এমনভাবে বাঁচা উচিত যেন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আরও হাজার বছর পড়ে আছে।
ফারুকের শিক্ষকতার জীবনে ওর মেধা ও যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থীকে ওর অনুরাগীতে পরিণত করতে পেরেছিল তা বোঝা যায় ওর মৃত্যুর পর কিছু শিক্ষার্থীর লেখা থেকে। প্রিয় শিক্ষককে হারিয়ে ওরা একজন অভিভাবককে হারিয়েছে। হারুনের কাছে শুনেছি ফারুকের জানাজায় কত শিক্ষার্থী এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। একজন ভালো মানুষের এটাই প্রাপ্তি। ফারুকের আত্মা এ দৃশ্যে নিশ্চয়ই পরিতৃপ্তি লাভ করেছে। কবি আল্লামা ইকবালের একটি ফারসি কবিতার দুটি লাইন হচ্ছে: “নিশান-এ-মর্দ-এ মোমিন বা তু গ্যয়াম/চুন মার্গ আয়াদ, তাবাসসুম বর লব-এ-ওস্ত,” (বলতে পারো, বিশ্বাসী মানুষের চিহ্ন কী?/মৃত্যু যখন তার কাছে আসে, তখনও তার ঠোঁটে লেগে থাকে হাসি।) মহান আল্লাহতা’য়ালা ফারুককে জান্নাতুল ফিরদাউসে দাখিল করুন।
Posted ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh