আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
‘আশা’ খ্যাত পল্লী উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচীর স্রঘমা ও সফল ব্যবস্থাপক সফিকুল হক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন আজ এক বছর হয়ে গেলো। মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমি আবেগ মিশ্রিত একটি নিবন্ধ তাকে নিয়ে লিখেছিলাম; আফ্রিকার পাঁচটি দেশের আশা আন্তর্জাতিক প্রকল্পসমূহের ব্যবস্থাপক ও উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন এমন কয়েকজনকে জড়ো করে হবিগঞ্জ কল্যাণ সমিতি ও জালালাবাদ এসোসিয়েশন, উত্তর আমেরিকা’র সৌজন্যে করোনা সময়ে ও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাইরাল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে পারিনি। আগ্রহ থাকলে ও বয়স, অসুস্থতার কারণে সম্ভব হয়নি। সান্ত্বনা ও গৌরব যুগপৎ এ জন্য যে আমার এ অনুজসম সফিকের সাধনা, দর্শন, ত্যাগ ও অর্জনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেশে বিদেশে প্রচুর হয়েছে এবং হতেই থাকবে তবে তার চেয়ে বেশী যা তার শুভানুধ্যায়ী সবার জন্য গৌরব ও তৃপ্তির তা হলো বাংলাদেশের লক্ষ কোটি গরীব নারী-পুরুষের অন্তরে সফিক অমর হয়ে থাকবে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সফিক ও আশা, আশা ও সফিক একাত্ম হয়ে বেঁচে থাকবে এশিয়া ও আফ্রিকার খেটে খাওয়া অগণিত ভাগ্যোন্নয়নে উদ্যোগী নারী-পুরুষের মনের মণিকোঠায়।
সফিক আর আমার নৈকট্য, আন্তরিকতা দীর্ঘ দিনের। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এক বছরের জুনিয়র হিসেবে তাকে পেয়েছি চার বছর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমি পাস করেছি ১৯৬৮ সালে, সফিক মাস্টার্স করেছে তার পরের বছর। একই জেলার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তার অনেক আত্মীয়স্বজনের সাথে পরিচয় ছিল। তার পিতাকে জানতাম স্থানীয় পর্যায়ে একজন সফল ও বরেণ্য নেতা হিসেবে। তিনি আজীবন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সফিকের মৃত্যুর কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ বিভিন্ন ভাবে মোটামুটি অব্যাহত ছিল।
ছাত্র জীবনে সফিক সাদা মাটা সহজ সরল জীবন যাপন করত। বড়লোকের ছেলেদের অনেক সময় অহমিকা থাকে। সফিকের মধ্যে তা কখনো দেখেনি। তার গ্রামের বাড়ী নরপতি আমার বাড়ী থেকে প্রায় ১২ মাইল দূরে পাশের থানা চুনারুঘাটে। তাদের এখানে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে বড় বান্নি (মেলা) হতো। আত্মীয় সজনের বাড়ীতে মাঝে মধ্যে ওঠেছি তবে সহপাঠী তাজুলদের (সফিকের চাচা) বাড়ীতেই থাকতাম বানি দেখতে গেলে। সহপাঠী মঈন উদ্দিন ও তার ভাই মহিউদ্দিন ভাই পিতাকে (হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মান্নান স্যার) না জানিয়েই চলে আসত কারণ স্যার ধর্মভীরু মানুষ বোলএ মেলা/বান্নি এসব পছন্দ করতেন না। চুঁটিয়ে আড্ডা দেয়া হতো। তবে, এক বছরের সিনিয়র হওয়ার সুবাদে আমার সাথে একটা সম্মানজনক দূরত্ব সফিক আজীবনই মেনে চলেছে।
আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে গ্রামের আপামর জনসাধারণের প্রতি সফিকের মমত্ব ও ভালবাসা তার ছাত্র জীবনেই লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এর আংশিক হলে ও পিতার কাছ থেকে পাওয়া। সরপঞ্চ এবং পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর এলাকার মানুষের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন তাঁর পিতা । সফিক সিভিল সার্ভিস পৃরিক্ষায় পাশ করে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ও সরকারি চাকুরী করার মোহ ত্যাগ করে গ্রামোন্নয়নের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমে পরেন। এ ফিল্ডে বাধাবিঘ্ন ছিল, অবাধ ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ও ছিলো। সফিক যখন আশা নিয়ে মাঠে নামে সে সময় স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রমুখ বেশ কিছু ব্যাক্তিত্ব, কয়েক ডজন এনজিও গ্রামোন্নয়নের কাজে মাঠে বিচরণ করছিল। প্রফেসর ইউনুস (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী) ও জোবরা গ্রামে তাঁর প্রায়োগিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী ধারণা ও আদর্শ প্রচার ও প্রসারে উঠেপড়ে নেমেছিলেন সে সময়ে। প্রয়াত মাহবুব আলম চাষী ও স্বনির্ভর কর্মসূচী রাঙ্গুনিয়ায় মনতোষ দাস সহ অপরাপর সঙ্গী সাথীদের সহায়তায় বাস্তবায়ন করতে ব্যস্ত হন প্রায় একই সময়ে।
স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সময়ে এই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় সফিকের সুবিধা ছিল। অনেক ডাকসাইটে আমলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মত বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সুযোগ তার তেমন ছিলনা বা প্রত্যাশা ও ছিলনা তবে দক্ষতা ও প্রশিক্ষণে তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে কাজ করার সুবাদে পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন কৌশল, মতবাদ ও আদর্শের সাথে নিবিড় পরিচয়ের সাথে একাডেমীর প্রায়োগিক গবেষণার সাথে পরিচিতি তাকে গ্রামোন্নয়্ন ও দারিদ্র বিমোচনে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে ওয়াকেফাল হতে সাহায্য করে । পরবর্তীতে জেদের বশে প্রচণ্ড অভিমানে তিনি একাডেমী ছেড়ে চলে যান। নামকরা এনজিও সিসিডিবি’তে প্রশিক্ষক হিসেবে এবং ম্যানেজমেন্ট বেশ ক’বছর কাজ করার পর তিনি তাঁর লালিত স্বপ্ন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য আশা (ASA -Association for Social Advancement) কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে মানিকগঞ্জের তেপরায় শুরু করে ধাপে ধাপে আশা দেশের ৬৪তি উপজেলায় প্রায় চার হাজার ব্রাঞ্চ অফিসের এবং পঁচিশ হাজারের মতো প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে প্রায় ৬০ লক্ষ নিন্ম আয়ের নারীপুরুষদের নিরন্তর সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক কর্মসূচীর পাশাপাশি সদস্যদের আইনী সাহায্য প্রদান, সচেতন করার জন্য নিত্য প্রশিক্ষণ, ঋণ ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান ইত্যাদি ও আশা নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে করে থাকে। নিয়মিত কাজের অনুষঙ্গ হিসেবে অবহিতকরন প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা ও সেই আশির দশকের শুরু থেকে চালু আছে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এ ব্যবস্থাপক দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ত্ব দূরীকরণে বাস্তববতাকে কখনো পাশ কাটিয়ে যাননি। জুতসই কর্মসূচী গ্রহণে সবসময় উদগ্রীব থাকতেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারে সদা সচেষ্ট সফিক তাঁর কর্মীবাহিনি ও তাদের প্রতিনিধিদের সাথে, সুফলভোগীদের সাথে আলাপআলোচনা করে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কর্মপন্থা গ্রহণ করতেন উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়াটা তাঁর ভীষণ অপছন্দের ছিল যেমন ছিল আমলাতন্ত্রের অহেতুক খবরদারি।
বিদেশী সাহায্যের উপর আশার নির্ভরশীলতা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর জীবদ্দশায়ই। এ সাফল্য ছিল স্বয়ম্ভরতার এক অনন্য উদাহরণ। অবশ্য ব্র্যাক ও এ ক্ষেত্রে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছে। বিদেশী উৎস থেকে না হলে ও প্রয়োজনে আশা পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে এখনো ঋণ নিচ্ছে বলে জানা যায়। সফিকের প্রতিষ্ঠিত আশা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যতিক্রম ধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ২০০৭ সালে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়টি নিন্ম আয়ের পরিবার থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিরাট সুবিধা বয়ে নিয়ে এসেছে। নাম মাত্র খরচে এখানে প্রায় ৫০০০ ছাত্র- ছাত্রী পড়াশুনা করে। আশার স্বাস্থ্য মিশন ও অনন্য। সফিকুল হক চৌধুরি তাঁর নিজ গ্রামে একটি অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। এতে বয়স্কদের জন্য আবাসন, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, এমনকি রেমিটেন্স ট্রেনিং সেন্টার-সব সুবিধাদি মিলিয়ে সুন্দর একটি সমন্বিত কমপ্লেক্স।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে সফিকের স্বপ্নের প্রকল্প আশা ইন্টারন্যাশনাল বা আশাই (ASAI) বর্তমানে ১৩টি দেশে সুনামের সাথে মাইক্রোফাইনান্স নিয়ে কাজ করছে। ঋণ দান, বিনিয়োগ ও ঋণ আদায়ের হার প্রায় শতভাগ। মূলত গরীব মহিলারা এ প্রকল্পগুলো থেকে সুফল ভোগ করছেন। এক জীবনে এত কাজ করে সফিক যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা যেমন প্রশংসনীয় তেমনি অনুকরণযোগ্য ও নিঃসন্দেহে । যারা সফিককে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর কাজ ও কীর্তির সাথে যাদের অল্প বিস্তর পরিচয় আছে তারা শ্লাঘার সাথে তা উল্লেখ করেন। আমি ও এই দলে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়,
“নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রাণের মাঝারে নিয়েছে সকল প্রেমের স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি ”।
(শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘অনন্ত প্রেম’, মানসী)।
Posted ১০:২০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh