শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

রোজিনা হেনস্থা কেন?

ড. মাহবুব হাসান   |   বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

রোজিনা হেনস্থা কেন?

আমার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বন্ধু ড.আবেদীন কাদের, হাসির একটি ইমুজি দিয়ে, আমার এক জিজ্ঞাসার উত্তরে ‘frailty ফ্রেইলটি’ শব্দটি লিখেছেন। এ-শব্দের সহজ বাংলা অর্থ বোধহয় দুর্বল বা দুর্বলতা। আমি জানতে চেয়েছিলাম গভর্নমেন্ট সারভেন্ট-এর মানে কী? আমরা যারা আম-জনতা, জানি যে তারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি। যে সব লোক স্বাধীনচেতা ও প্রচলকে ভেঙে দিতে উৎসাহী, তারা বলেন ওরা তো জনগণের চাকর। সারভেন্ট অব দ্য পিপল। কিন্তু বিষয়টা তো ওইরকম না। যারা এই প্রশাসন স্ট্রাকচারটি গড়ে তুলেছেন, তারা ছিলেন ‘ভীষণরকম’ বুদ্ধিমান। নামে তারা ‘সারভেন্ট’ কিন্তু কাজে তারা ‘প্রভু’। মানে সব ক্ষমতাই তার হাতে। তিনি বা তারা কলম বাগিয়ে বসে পরিকল্পনা করেন, জনগণের জন্য কি কি করবেন। উন্নয়ন প্লান জনগণের জন্য, টাকাটা জনগণের তহবিলের, কেবল খরচটা তিনি বা তারা করবেন। আমি মনে করি তারা জনগণের সেবাদানকারী কর্মী। আমরা গণতান্ত্রিক মননের লোকজন মনে করি, সরকার যেহেতু জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত, তারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই সরকার হচ্ছে জনগণ আর সরকারের যারা হোমড়া-চোমড়া কর্মকর্তা তারা সরকার তথা জনগণের চাকর।

বঙ্গবন্ধুর রেফারেন্স এখানে দেয়া যেতে পারে। তিনি এক রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন ‘ আপনারা জনগণকে সেবা দেবার জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। তারা আপনার কাছে আসলে তাকে সসম্মানে সালাম দিয়ে বসতে দেবেন এবং তার কাজ করে দেবেন। তার কাজ করে দেবার জন্যই আপনাকে রাখা হয়েছে। জনগণের অর্থেই আপনাদের বেতনভাতা হচ্ছে।’ আমি হুবহু কথাগুলো লিখতে পারলাম না। কারণ টিভিতে শোনা তাঁর বক্তৃতা থেকে যতটুকু মনে পড়লো তাই উদ্ধৃত করলাম। মূল কথা হলো তিনিও মনে করতেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা জনগণকে সেবা দিতেই রাখা হয়েছে। তারা যেন জনগণকে বিনা উজোর-আপত্তিতে সেবা দেয়, সেই কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ উঠেছিলো কর্মকর্তারা সেবার চেয়ে জনগণকে ‘দুর্ভোগ’ [সব সময় নয়, সবক্ষেত্রেও নয়] দিতে বেশি ভালোবাসেন। সুদূর অতীত থেকে আজতক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এটাই প্রধান অভিযোগ। দ্বিতীয় অভিযোগ তারা প্রশাসনিক কাজে ক্ষমতার দাপট দেখান, আগত মানুষদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন। তৃতীয় অভিযোগ হলো –তাদের আচরণ প্রভুর মতো। তার কাছে আগত লোকেরা ভৃত্যের মতো বা মূল্যহীন মানুষ তারা। কর্মকর্তাকে স্যর না বললে তিনি গোস্যা করেন, কখনো কখনো ধমকান। কেতাদুরস্ত ওই সব কর্মকর্তা যেন সরকারের প্রতিভূ শক্তি বা রাজ কর্মকর্তা। তাদের জন্য চাকর-বাকর, ড্রাইভার, গাড়ি বাড়ি ইত্যাদি দেয়া হয়। প্রশাসনের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন সেক্রেটারির জন্য রয়েছে একজন পিএস বা প্রাইভেট সেক্রেটারি। ওই সেক্রেটারির রয়েছে আরেকজন এ্যাডমিন ক্যাডারের সেক্রেটারি, এডিশনাল ও জয়েন্ট সেক্রেটারি রয়েছেন দু- দুজন, ডেপুটি সেক্রেটারি আছেন কয়েকজন –এদের প্রত্যেকেরই আবার আছে পিএস ও অন্যান্য কর্মকর্তা।


প্রশাসনের এই স্ট্রাকচার সন্দেহ নেই একটি মাথাভারী স্ট্রাকচার। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিরা এই স্ট্রাকচার রেখেছিলো নিজেদের সুবিধার জন্য। এরা এতোটাই দ্রুতগতিতে কর্ম সম্পাদন করেন যে আমাদের মনে পড়ে যায় খরগোস ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার প্রতীকী গল্পটি। ধুপদুরস্ত কর্মকর্তাগণ এতো দ্রুত কাজ করেন যে লক্ষ্যে পৌছানোর আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন বিজয়ের উল্লাস বুকে জড়িয়ে। আর ধীরগতির সাধারণ মানুষের প্রতীক কচ্ছপ ঠিকই নিরলসভাবে এগিয়ে যায় এবং বিজয় অর্জন করে।

প্রতীকী গল্পটির ইতি এখানেই টানছি। কারণ আমার এ-লেখার মূল উদ্দেশ্য ওই সরকারি কর্মকর্তাদের অসততা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি সম্পর্কে। সেই সাথে তারা যে একটি ভঙ্গুর ও ঘুণে খাওয়া প্রশাসন কাঁধে নিয়ে স্বাধীন দেশের জনগণকে সেবা দিতে প্রস্তুত তা যে আসলে একটি পরিত্যক্ত ঔপনিবেশিক ‘রাজা আর প্রজার’ কাহিনীর মতো ব্যবস্থা, তা তারা জানেও না, বোঝেও না। রাজার কোনো ভুল নেই, ত্রুটির তো কোনো প্রশ্নই আসে না। রাজা অলওয়েজ রাইট।


ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের তৈরি প্রশাসনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো নেটিভরা তাদের প্রজা এবং তারা অপরাধপ্রবণ। কারণ তারা উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চায়। ১৮৬৩ সালে যখন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলে ব্রিটিশের ভারত সরকার, তখন পুলিশদের শিক্ষা দেয়া হয় এভাবে- স্থানীয়রা অপরাধপ্রবণ। তাদেরকে শাসনে রাখতে হবে। তাদেরকে মেরে-কেটে হলেও প্রশাসনের ধারে-কাছে আসতে দেয়া যাবে না। কারণ ঔপনিবেশিক সরকারের অনেক ষড়যন্ত্রের নীল নকশা সেই সব প্রশাসনিক ফাইলে গোপনীয় বা কনফিডেনশিয়াল ট্যাগ দিয়ে রাখা হতো এবং তা আজো প্রচলিত।

আজকে, স্বাধীন দেশের পুলিশের মনোভঙ্গিও ঠিক সেই রকম। শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা যে নরকগুলজার করে জনজীবনে, তার তুলনা উপমহাদেশগুলো ছাড়া আর কোথাও নেই। আজকে দেখতে পাচ্ছি কেবল পুলিশই নয়, সরকারি কর্মকর্তারাও উগ্রচন্ড মাতঙ্গিনী হয়ে উঠেছেন। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে তথ্য তো দেয়ইনি অতিরিক্ত সচিব, তিনি তাকে চোর হিসেবে ধরে আটকে রেখেছেন ৬ ঘন্টা। তারপর পুলিশের হাতে দিয়েছেন। পুলিশ বিবেকবর্জিত। তারা শুধু আদেশ পালন করে থাকে। নিম্নআদালতের বিচারকগণ তো প্রশাসন ক্যাডারেরই লোক। ওপর থেকে যা বলবে, সে তাই করবে। আদালত রোজিনাকে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন রোজিনাকে হেনস্থা করা হয়নি। তবে, ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে রোজিনার গলা চেপে ধরেছেন অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা। রোজিনার পার্স টানাটানি করতেও দেখা গেছে তাকে।


রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য যা সংরক্ষিত থাকবার কথা সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের সুরক্ষিত ড্রয়ারে। কিন্তু আমরা জেনেছি, সে ফাইলটি ছিলো পিএস-এর টেবিলে। এবং তা ছিলো অরক্ষিত অবস্থায়। পিএস-এর টেবিলে পড়েছিলো সেটি। রোজিনা বোধহয় সেই ফাইল থেকে কিছু তথ্যের ছবি তুলে নেন মোবাইলে। সেটাই তার অপরাধ। রোজিনা বেশ কিছুদিন ধরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস করছিলেন তার পত্রিকা প্রথম আলোতে। তিনি একজন সিনিয়র ও অনুসন্ধানী রিপোর্টার। তিনি বিপুল সুনামের অধিকারী তার রিপোর্টের মাধ্যমে। আমাদের সংবিধানে সংবাদপ্রত্র ও ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমের সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ বা ফোর্থ এস্টেট’ হিসেবে অভিসিক্ত করেছে। বিশ্বের সব দেশই এই স্বীকৃতি দিয়েছে গণমাধ্যমকে। তারপরও অবাধ তথ্য পাওয়ার অধিকারীরা প্রশাসনের লোকেদের সহযোগিতা পান না।রোজিনাকে হেনস্থার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা সোচ্চার হয়েছেন। তারা রাজপথে মানববন্ধন ও বক্তৃতা দিয়ে এর সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন সরকারের কাছে।এগুলো হলো ঘটনাপ্রবাহের কিছু কিছু বর্ণনা। আসলে এর চেয়েও গভীরতর ক্ষতির যজ্ঞ চলছে প্রশাসনের অভ্যন্তরে। প্রশাসনের উচ্চস্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতাবান সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ তাদের ‘সমিতি’র লোকেরা কি করে জেবুন্নেসাকে বাঁচানো যায় সেই ফিকির করছেন। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের স্বভাব অনুযায়ী এমনটাই করার কথা।

রাজনৈতিক সরকারের ইমেজ কতোটা নষ্ট হলো তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে, কথা হচ্ছে সর্বত্রই যে এ-সরকারের তো কোনো ভালো ইমেজ নেই। যা আছে তা দুর্নীতি আর লুটপাটের জন্য চ্যাম্পিয়নশিপের ইমেজ। ভোট ডাকাতি মানে ভোটের আগের রাতে ব্যালট চুরি করে নিয়ে সিল বসিয়ে তারা জিতেছেন সরকারের থাকবার টিকিট। সরকারের এই ইমেজের কাছে কাজী জেবুন্নেসার এই অপকর্ম নস্যিমাত্র। এটা তো বাইরের লোক জানতেই পারতো না, যদি রোজিনা সাংবাদিক না হতো। সাংবাদিকদের পয়সা ও ক্ষমতা না থাকলেও তাদের গোস্যা করার অধিকার তো আছে। সরকারের বিরুদ্ধে যদি তারা গোস্যা করেন, তাহলে সরকারের গুণগান করবে কারা? মিথ্যা উন্নয়ন আর লুটপাটের জন্য বিগ বিগ প্রকল্পের স্বপ্ন-উন্নয়ন ধারার স্রোত কারা দেখাবে দেশবাসীকে? দু’চারজন রোজিনার রিপোর্টের ফলে সরকারের শক্তিশালী রাজনৈতিক ও উন্নয়ন ইমেজ নষ্ট হবে না। তারপরও আমরা জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক হস্তক্ষেপে এই সমস্যা অচিরেই ধামাচাপা পড়ে যাবে আরেকটি ইস্যুর অন্তরালে।আর কয়েকটি দিন সবুর করুন প্রিয় পাঠক সমাজ- আসছে নতুন ইস্যুর এপিসোড।

Posted ১১:০০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6374 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1316 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1157 বার পঠিত)

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.