আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
গত মাসে (আগস্ট ২০২২) সালমান রুশদির ওপর হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার একটি লেখা পাঠ করে আমার ফেসবুক বন্ধুদের অনেকে ‘গোসসা’ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে আমার লেখা আমার অনেক ঘনিষ্ট লোকজনের ‘গোসসা’র খোরাক হয়েছে। এমনকি আমার স্ত্রী পর্যন্ত আমার অনেক লেখায় কোন বাক্য, কোন শব্দ প্রয়োগ অনুচিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমাকে নসিহত করেন। আমাকে হিসেব করে লিখতে হয়। আমি ভাবি, আমার ঘরেই যখন এই অবস্থা, তখন মতামত প্রকাশের ওপর সরকার সেন্সরশিপ আরোপ করলে এত আপত্তি ওঠে কেন? সেন্সরশিপ আরোপ করলেই বা কী আসে যায়? পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর জুড়েই সংবাদপত্রের খবরের ওপর সেন্সরশিপ ছিল। সত্য যত চেপে রাখা হয়, গুজব ও অসন্তোষ তত বাড়ে। খবর চেপে রাখতে সামরিক শাসকরা ১৯৭১ এর মার্চে সব বিদেশি সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিস্কার করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আর ‘পাকিস্তান’ থাকেনি।
১৬৪৪ সালে কবি জন মিল্টন পার্লামেন্টে তাঁর আবেদনে বলেন, “সব ধরনের স্বাধীনতার ওপর আমাকে আমার বিবেক অনুযায়ী জানার, বলার এবং অবাধে যুক্তি প্রদর্শনের স্বাধীনতা দিন।” কথা বলার স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার হলেও তা হঠাৎ করে আসেনি, ধাপে ধাপে এসেছে এবং পুরোপুরি এসেছে এবং পুরোপুরি এসেছে তাও বলা যাবে না। এ অধিকার আইনে স্বীকৃত হলেও পিছিয়ে পড়া সমাজে এখনও মেপে কথা বলতে হয়। কী বলা যাবে, তা কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ঠিক করে দেয়। কোনো সংবাদপত্র কিছু প্রকাশ করলে তা যদি সরকারের পছন্দ না হয় সরকার সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়; বই এর ক্ষেত্রে বই নিষিদ্ধ করে, লেখক প্রকাশককে গ্রেফতার করে, যা দেখে মুক্ত বুদ্ধির চর্চাকারীরা মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হন। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
আমেরিকান ইতিহাসবিদ আলফ্রেড হুইটনি গ্রিসওল্ড লিখেছেন, “বই নিষিদ্ধ থাকতে পারে না– ধ্যান-ধারণা কারাগারে যেতে পারে না। ইতিহাসের দীর্ঘ গতিপথ প্রমাণ করেছে অবদমন ও ধর্মীয় তদন্তকারীরা সবসময় পরাজিত হয়েছে। যখনই কোনো বই পোড়ানো হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সে আগুনে মানুষ দগ্ধ হয়েছে।” অনেক সময় গান নিয়ে আপত্তি ওঠেছে। শিল্পী হ্যারি বেলাফন্ট বলেছেন, “আপনারা একজন সঙ্গীত শিল্পীকে খাঁচায় পুরে রাখতে পারেন, কিন্তু গানকে নয়।” গণতন্ত্রের জন্য পড়াশোনা করা জানা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু তা হামলার মুখে। সৃজনশীল বই শুধু নয়, টেক্সট বই পর্যন্ত এ হামলার বাইরে নয়। সবকিছু সবার ভালো লাগবে অথবা ভালো লাগতেই হবে, এমন চিন্তা-চেতনার দিনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। জ্ঞানের দ্বার অবারিত হওয়া আবশ্যক।
১৮৭৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেস জন্ম নিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত ও যৌন ব্যাধি বিষয়ক প্রকাশনা নিষিদ্ধ করায় ডাক বিভাগ মেডিকেল ছাত্রদের কাছে অ্যানাটমির বই পর্যন্ত পাঠাতে পারতো না। প্ল্যানড প্যারেন্টহুড জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে আন্দোলন করায় প্রায় চার হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, পনেরো জন আত্মহত্যা করেছিল এবং এ সংক্রান্ত ১৫ টন বই পুস্তিকা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ এখন বিশ্বজনীন অধিকার।
১৯৩৪ সালে প্যারিস থেকে হেনরি মিলারের যৌন বিবরণ সম্বলিত উপন্যাস “ট্রপিক অফ ক্যান্সার” প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে আমেরিকান গ্রোভ প্রেস পুনরায় বইটি মুদ্রণ করার পর এর বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা হয় এবং একটি আদালত রায় দেয় যে “এটি কোনো বই নয়, এটি খোলা নর্দমা, নৈতিকতার অবক্ষয়ের দুর্গন্ধ যুক্ত আবর্জনা।” তিন বছর পর আরেকটি আদালত রায় দেয়, “বইটি অশ্লীল নয়।” অতএব পার্থক্য দৃষ্টিভঙ্গির। লেখকের অবশ্যই উচিত তাঁর সম্ভাব্য পাঠকগোষ্ঠীর সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং তাঁর নিজের অধিকারের সীমা বিবেচনায় রাখা। পাঠকের প্রতি দায়িত্ব বোধ থেকেই তিনি তা করতে পারেন।
১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে “স্যাটানিক ভার্সেস” প্রকাশিত হওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস পর ১৯৮৯ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি আয়াতুল্লাহ খোমেনি সালমান রুশদি ও প্রকাশককে হত্যার ফতোয়া দিয়ে ফরমান জারি করেন। সেই ঘোষণার পর তেত্রিশ বছর কেটে গেছে। এরই মধ্যে বেশ ক’টি উন্নত দেশে “স্যাটানিক ভার্সেস” এর অনুবাদক ও প্রকাশকদের হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর হুমকি মাথায় নিয়ে রুশদি তাঁর সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছিলেন। প্রায় এক দশক তাঁকে কার্যত আত্মগোপনে কাটানো পর তিনি অনেকটাই প্রকাশ্যে এসেছিলেন। বিভিন্ন দেশে সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিলেন, প্রকাশিত নতুন বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন, গণমাধ্যমেও আসছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কে তাঁকে প্রাণঘাতী আক্রমণের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। সালমান রুশদির ওপর হামলা করে কী হয়েছে? হামলার পর দুই সপ্তাহের মধ্যে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর পেপারব্যাক এডিশনের ২৪,৪৯১টি বই বিক্রয় হয়েছে। সেটি আবার ফিরে এসেছে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়।
মুসলিম দেশগুলোতে “স্যাটানিক ভার্সেস” এখনও নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকাভূক্ত। শুধু মুসলিম দেশ নয়, ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করেছিল সবার আগে। এটা নতুন কিছু নয়। কোনো বিষয়ে কারও মতামত ব্যক্ত করার কারণে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতেই হয়। প্রাচীনকালেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কিছু প্রাচীন গ্রীক ও রোমান পণ্ডিত ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল থাকার কথা বলেছেন, কিন্তু গ্রীকরাই সক্রেটিসকে হত্যা করেছিল তাঁর বিরুদ্ধে যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করা ও রাষ্ট্রের স্বীকৃত দেবতাদের বিশ্বাস না করার অভিযোগ এনে। একটি সময় পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের নিষেধ করা হয় রেনে ডেসকারটেস, গ্যালিলিও, ডেভিড হিউম, জন লক, ড্যানিয়েল ডেফো, রুশো, ভলতেয়ারসহ আরও অনেক মুক্ত চিন্তা দার্শনিক-লেখকদের বই। এখন আমরা সেগুলো পাঠ করেই নিজেদের সমৃদ্ধ করি।
কার মনের মধ্যে কী চলছে, তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? “স্যাটানিক ভার্সেস” এর চেয়েও ইসলাম ও মহানবী বিরোধী জঘন্য বই আসবে না কোন আইন সেই গ্যারান্টি কে দেবে? অতীতেও দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। আমার যা পছন্দ হবে না, আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে আমি তার প্রতিবাদ করতে পারি। কারও কল্লা কাটতে পারি না।
Posted ১:১০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh