ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
(শেষাংশ) : প্রাক কথা
নিবন্ধটির প্রথম অংশ আমেরিকায় ১৬০৭ থেকে ১৭৮৩ পর্যন্ত স্থায়ী ব্রিটিশ কলোনির পরসমাপ্তির নাতিদীর্ঘ ইতিহাস উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল । বেশ জোরের সাথে এ সত্য ও বিধৃত করা হয়েছিল যে যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপের সম্পদশালী দেশগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অনগ্রসর জনপদে কলোনি স্থাপনের পরিবর্তে নিজ দেশে আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা আনয়ন করে শিল্পকারখানা, কৃষি ও পশুপালন খামার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বনির্ভর দেশ ও সমাজ এবং আত্মনির্ভর পরিবার গঠনই প্রথম যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশটির সরকার ও জনমানুষের প্রধান লক্ষ্য ছিল । ক্রীতদাসের শ্রমে তূলা চাষ সহ বড় বড় কৃষি খামার গড়ে তোলা হয়। বন্য জন্তু, বৈরী পরিবেশ, আদিবাসীদের সাথে নিত্য সংঘর্ষ এসব মোকাবেলা করে তবেই শক্ত অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলতে হয়েছে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও উড্রু উইলসন : স্বাধীন আমেরিকায় গণতন্ত্র, প্রগতি, ও স্বনির্ভরতার কথা দেশটির ২৮ তম প্রেসিডেন্ট উড্রু উইলসন যে আন্তরিকতার সাথে, দরদ দিয়ে, দেশপ্রেমের সকল অভিপ্রায় থেকে বলেছেন তা তাঁর পূর্বে কম প্রেসিডেন্টই বলেছেন। আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ওয়াশিংটন এঁরা ও দেশর জন্য অনেক সুকর্ম করেছেন কিন্তু উড্রু উইলসন ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে যখন পৃথিবীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে সে সময় এবং পুরো যুদ্ধ সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সফল বাভে পরিচালনা করেছেন। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী পাদ্রির সন্তান উড্রু উইলসন অত্যন্ত সুশিক্ষিত ছিলেন। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির মতো সুবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। নিউ জার্সি অঙ্গ রাজ্যের গভর্নর হিসেবে ও কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। ১৯১২ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির টিকেটে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দু দফায় এ গুরু দায়িত্ব পালন করেন । বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারে তাঁর সুখ্যাতি ছিল তবে নিজের দেশে বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গ ও ক্রীতদাসদের সামাজিক , অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে তিনি কোন ভূমিকাই রাখেননি। তইনি বর্ণবাদে া ক্রীতদাস তথা কৃষ্ণাঙ্গদের বিচ্ছিন্ন সামাজিক অবস্থান উপর আরোপিত বিধি-নিষেধ (segregation) উচ্ছেদ করার ব্যাপারে চরম উদাসীন ছিলেন । অনস্বীকার্য যে উদার গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে আমেরিকার যে জগতব্যাপী খ্যাতি এর জন্য উড্রু উইলসনের নাম ইতিহাসে সবসময়ই উঁচু স্থানে থাকবে। জ্ঞানচর্চার অন্যতম শাখা লোক প্রশাসন ও পাবলিক পলিসির জনক হিসেবে খ্যাত এ পণ্ডিত একজন অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রপ্রধানই ছিলেন না রাজনীতি, কূটনীতি, পররাষ্ট্র ও সমর বিশারদ হিসেবে তাঁর কৌশল ও মতামত যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর ইউরোপের নেতারা মেনে নিতে তেমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতেন না। যৌক্তিকতা দিয়ে তিনি প্রতিটি আন্তর্জাতিক সমস্যা বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করতেন । যুদ্ধ নিয়ে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখে তিনি যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি কংগ্রেস ও জাতির সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে যোগ দেয়া জরুরি কেন তা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন ।
তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে এ যুদ্ধে আমেরিকা যোগদান না করলে বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসার ও বিকাশ দারুণ ভাবে ব্যাহত হবে; যারাই জিতবে তাঁরা আফ্রিকা, আরব অঞ্চল, ইউরোপের বিজিত দেশ গুলো ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে মত্ত হবে এবং চুক্তির মাধ্যমে যে সমজোতা হবে তাতে পৃথিবীতে কলোনির সংখ্যা বাড়বে । তাঁর ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে যোগদানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড়ো অর্জন হবে “ to make the world safe for democracy”. । ১৯১৮ সালের জানুয়ারী মাসের ৮ তারিখে কংগ্রেসে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি তাঁর সুবিখ্যাত ১৪ দফা (ভড়ঁৎঃববহ ঢ়ড়রহঃং) উপস্থাপন করেন। এতে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে আমেরিকার ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা উপস্থাপন করেন । তাছাড়া, সমুদ্র ব্যবহারের স্বাধীনতা, ট্রেড ফ্রীডম, এবং আত্মনির্ভরশীলতার উপর জোর দেন । ইউরোপীয় কতিপয় দেশের সাম্রাজ্য বিস্তার ও কলোনি স্থাপন স্পৃহা প্রতিহত করার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন । পরিবর্তে , বর্তমানে যে সব কলোনি বিদ্যমান আছে সেগুলোকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। যুদ্ধে জয়লাভের ফলশ্রুতিতে বিজিত দেশ ও অঞ্চলগুলোকে ও স্বাধীন, সার্বভৌম গন্তন্ত্রাতিক দেশ হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে এ দাবি ও উত্তাপন করেন। উড্রউ উইলসনের সর্বশেষ দফা ছিল সকল দেশর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পারস্পরিক সম্মতি আদায়ে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করতে হবে। যদিও আমেরিকার কংগ্রেসের প্রচণ্ড বাঁধার মুখে এ দাবীটি কার্যকর উড্রু উইলসনের সময়ে করা যায়নি তবে পরবর্তীতে লীগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠা তাঁর প্রস্থাবের ভিত্তিতেই হয়েছিল । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হলে ও জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা ও একই ধারাবাহিকতায় হয়েছিল।
উড্রু উইলসন বার্সাই চুক্তি (to make the world safe for democracy) মানতে রাজ্যই হন নি। তাঁর মতে এটি একটি গোপন চুক্তি ছিল যার উদ্দেশ্য যাতে কলোনি স্থাপনকারী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যুদ্ধ শেষে বিজিত দেশগুলোকে ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে পারে নিজেদের পারস্পরিক স্বার্থে । গণতন্ত্রে বিশ্বাসী উইলসন সকলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার ভিত্তিতে এ সমস্যা নিষ্পত্তি করতে চাপ দেন । মিত্র দেশগুলো তাঁর ১৪ দফা মেনে নিলে বার্সাই চুক্তিটি সংশোধন করে এবং এ নতাবেকি প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ তম প্রেসিডেন্ট যে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের কাণ্ডারি হিসেবে বিশ্বের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । অবশ্য তাঁর পূর্ব ও উত্তরসূরি অনেকেই যেমন জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিঙ্কন, জন অ্যাডামস, জন এফ কেনেডি প্রমুখ প্রেসিডেন্টগণ ও গণতন্ত্রের বীজ বপন, মূল্যবোধ সঞ্চালন এবং এর প্রসার ও বিকাশে প্রচুর অবদান রেখেছেন । তবে, ইতিহাসের একটি বিশেষ ক্রান্তিকালে উড্রু উইলসনের মতো দৃঢ়টার সাথে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, চেতনা ও প্রয়োগ এর কেও করেননি।
Posted ১১:১০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh