ড. মাহবুব হাসান | বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১
শামসুদ্দিন পেয়ারা’র একটি বই ন্যু-ইয়র্ক বইমেলা থেকে কিনেছি। ‘আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’। আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে আমার যেমন তীব্র আগ্রহ আছে তেমনি কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়েও। কারণ তারা আমাদের রাজনীতির নিয়ন্তাশক্তি এবং স্বাধীনতারও অনুঘটক। তাদেরই একজন সিরাজুল আলম খান। জাসদের সবার কাছেই তিনি ‘দাদা’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৫ কিংবা ৮৬ সালের মধ্যভাগে তিনি একদিন এসেছিলেন আমার অফিসে,দৈনিক জনতা’য়। বসেছিলেন আমার টেবিলে। সে সময়টা টালমাটাল সময় রাজনৈতিক চোরাস্রোতের রমরমা চলছে। ঘন্টা দুয়েক ধরে তিনি কথা বলেছিলেন। বিষয় ছিলো ডিসেন্ট্রালাইজেশন অব পাওয়ার। এরশাদ তখন প্রশাসনে কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা উপজেলা স্তরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হাইকোর্টকে তিনি বিভাগে স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু আইনজীবীরা তা মানছিলেন না। ক্ষমতার কেন্দ্র রাজধানীকে ভারমুক্ত করতেই বোধহয় এরশাদ এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যতদূর মনে আছে আমার সেই মধ্যদুপুরে তিনি কথা বলছিলেন এ-বিষয়ে। আমি শুনছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো ক্ষমতা ভাগাভাগির যে চিন্তা সিরাজুল আলম খানের চিন্তার মৌলধারা, এরশাদের এই উপজেলা কেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন ব্যবস্থা করার পদক্ষেপটি তার ভালো লেগেছিলো মনে হয়।
তবে আমি তার যুক্তি গ্রাহ্য করেছিলাম এমন নয়। আমি শুনছিলাম কেবল। আমি সরাসরি রাজনীতি না করলেও আমার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারা আছে, যার সাথে তার অনেক চেতনা মিলে যায়। আজ যখন শামসুদ্দিন পেয়ারার বইয়ের ভাষ্যে পেলাম তার কথাগুলো আরো বিস্তৃত আকারে, তিনি অনেকাংশেই যথার্থ বলেছেন বলে মনে হচ্ছে। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব তিনি করেছিলেন তার গঠিত ‘নিউক্লিয়াসের’ দাবি হিসেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব না মেনে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করেছিলেন। বোঝা গেলো এতে সিরাজুল আলম খান ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি ও তারা,—- যারা চেয়েছিলেন জাতীয় সরকার কায়েম হোক, তাদের অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু দলীয় সরকার করেছিলেন। এবং তিনি তাজউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কেন তিনি এমনটা করেছিলেন? সাধারণ যুক্তি হচ্ছে ক্ষমতা। বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক ক্ষমতাই চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে। সেটা বোঝা যায় ৭ মার্চের অনন্যসাধারণ ভাষণের পরও তিনি পাকিস্তানি সরকারের প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়ার অধিকারকে বাস্তব করার চেষ্টা থেকেই। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—জনপ্রত্যাশার এই বাণী উচ্চারণের পর কি করে তিনি স্বাধীনতার পথে না হেঁটে, মুক্তির পথে না গিয়ে ইয়াহিয়ার সাথে, ভূট্টোর সাথে আলোচনায় বসলেন?
সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী— ইয়াহিয়া তাকে প্রস্তাব করেছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রী করার। ইয়াহিয়া ফিরে যাওয়ার দিন সকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে নাকি চরম দুর্ব্যবহার করেছিলেন।
‘‘আমি দুপুরে গেলাম। [ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ] তিনি বললেন,‘‘ইয়াহিয়া আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।’’
মুজিব ভাই বললেন, ‘‘আগামীকাল রাতেই ওরা আক্রমণ করবে। প্রথম পরযায়েই প্রতিরোধটা যেন শক্ত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘‘কাউকে বলিস না। আমি বাসাতেই থাকবো। আমাকে না পেলে ওরা উন্মাদের মতো আচরণ করবে আর সে সুযোগে আমাকে মেরেও ফেলবে।’’ [ পৃ. ১৩২ ]
এবং বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাত বারোটার পর আক্রমণ করা হবে, বলেছিলেন ইয়াহিয়া। তিনি পালাবেন না, কারণ তাতে নাকি পাকিরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে আরো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাবে। এটাই বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য বলে লিখেছেন সিরাজুল আলম খান।
কিন্তু এই প্রজ্ঞাবান [ সিরাজুল আলম খান ] একবারও ভাবেননি যে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি গণপরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী দলটি কি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার গঠন করতে পারেন কি না! বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান হয়েছে, নেতৃত্ব আওয়ামী লীগই ছিলো মুক্তিযুদ্ধে, অন্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষও যে জীবন দিয়ে দেশটি স্বাধীন করেছিলো, তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে,‘ জাতীয় সরকার’ গঠন না করে ‘দলীয় সরকার’ গঠন যে অবৈধ— সে প্রশ্নটি তিনি তোলেননি। কারণ শেখ মুজিব শতসহস্র ভুল করলেও তিনি তাকে ছেড়ে যাবেন না, যাননি, সে কথাগুলোই তিনি বলেছেন। তাহলে তার রাজনৈতিক চেতনার সাথে গড়মিল হওয়া সত্ত্বেও এবং পরে জাসদের কর্মীদের হত্যা করা বঙ্গবন্ধু সরকারকে তিনি দোষারোপ করলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ ছাড়েননি। তার মানে তিনিও একধরনের রাজনৈতিক আবেগের ঘেরাটোপে বন্দী। আর সেই বন্দীদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাননি। যার নির্দেশে হাজার হাজার জাসদকর্মী হত্যার শিকার হলো এবং বামপন্থী রাজনৈতিকর্মীদের হত্যা করা হলো, তাকে কিভাবে সিরাজুল আলম খানের মতো একজন শিক্ষিত প্রজ্ঞাবান তার রাজনৈতিক গুরু হিসেবে অটুট রাখলেন? ঔপনিবেশিক রাজনীতির ধারা এবং তাদেরই শাসন ব্যবস্থা কায়েমকারী শেখ মুজিব যে সিরাজুল আলম খানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তার কাছে মাথা নত করেনি, করতে পারে না, সেটা খান বুঝতে পারলেও তার মোহভঙ্গ হয়নি। এখানেই ব্যক্তি সিরাজুল আলম খান বন্দী।
এই বইয়ে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার চিত্র নেই বললেই চলে। গোটা ঢাকা শহর যে রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো তার ছিটেফোটা বর্ণানাও নেই। ‘দাদা’ কি করলেন, কিভাবে ঢাকা ছেড়ে গেলেন, তারও বর্ণনা নেই বিশদে। তবে পেয়ারার এই বইয়ে বেশ কিছু ভালো তথ্য আছে, যা ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এতোদিন আমরা পড়ে জেনেছি, লোকমুখে শুনে আসছি যে বঙ্গবন্ধু পিলখানার ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন হান্নান সাহেবের কাছে। আর পেয়ারার এই বইয়ে দাদা’র ভাষ্য হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে পুলিশের মাধ্যমে যে বার্তা দিয়েছিলেন তাহলো : The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours, Insha Allah. Joy Bangla. Mujibur Rahman ( শত্রুরা আমাদের আঘাত করেছে। আপনারা পাল্টা আঘাত করুন। ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের হবেই। জয়বাংলা। মুজিবুর রহমান ) [ পৃষ্ঠা : ১৩২ ] এই ঘোষণাটি মোসাবিদা করে দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল সেই মোসাবিদাটি তাজউদ্দিন ও সিরাজুল আলম খানকে সেটা নিয়ে যেতে বলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে।
এই বইয়ে লেখা হয়েছে যে সিরাজুল আলম খান ২৫ মার্চ রাতে লালবাগ থানায় কাটিয়েছেন। ওই দিন রাতেই তিনি ওই ঘোষণা লালবাগ থানায় বসে ওয়্যারলেসে শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।
Posted ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh