আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২
ঘটনা দু’টো পরিকল্পিত না হলে ও কাকতালীয় নয় অবশ্যই । কিছু কিছু বিষয় বা ইস্যু বিভিন্ন সময়ের প্রয়োজনে, এমনকি সার্বজনীনতায় আবির্ভূত হয়ে আমাদের উদ্বেলিত করে, বিবেককে এমন ভাবে আন্দোলিত করে যে এর অনেকগুলোই মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে আত্মিকরণের পর্যায়ে চলে আসে। এমনতরো ইস্যুগুলোর মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সময়ের নিরিখে, মানবজাতি তথা তাবৎ সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার তাগিদে নিশ্চয়ই প্রথম কাতারে স্থান করে নিয়েছে আমার মতো অনেকের প্রতি মুহূর্তের চিন্তায়, মননে, কাজকর্মে। এ বিষয়টির চেয়ে অগ্রাধিকের ভিত্তিতে বিবেচনার দাবী বর্তমান সময়ে আর কোন সমস্যা আমাদের সামনে নেই । যুদ্ধ, মহামারী ও সাম্প্রতিক সময়ে ও বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি সর্বগ্রাসী একটি সমস্যা ।
জাতিসঙ্ঘের আহ্বানে রিও ডি জেনিরো বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানদের সভায় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে ইউ এন ফ্রেমওয়ার্ক সম্মতির ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরই আয়োজিত হয়ে আসছে । কোভিড ১৯ এর কারণে এক বছর বাদ গেলে ও ২০২১ গ্লাসগোতে নব উদ্যমে ও প্রতিজ্ঞায় ইউএন ক্লাইমেট কনফারেন্স হয়ে গেল। নিউ ইয়র্ক নগরী থেকে ১২,৬৪২ কিলোমিটার বা ৭,৮৫৫ মাইল উড়ে গিয়ে আমার জন্মস্থান মাধবপুরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে লেখা গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিজ্ঞ বক্তাদের মুখে আমি কিছুকিছু যে বক্তব্য, সমস্যার স্বরূপ, সমাধানের উপায় ও প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হতে শুনেছি তা আমাকে অভিভূত করেছে, আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষমান থাকার খুশির বার্তা শুনিয়েছে ।
বাংলাদেশ সরকারের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিভিল সার্ভিস একাডেমীর এমডিএস এবং অতিরিক্ত সচিব ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বার বার উল্লেখ্য করেছেন শিল্পায়নের পথে দ্রুত অগ্রসরমান লেখকের জন্মস্থানে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । পুস্তক দুটোর(অন্য পুস্তকটি সামাজিক স্তরবিন্যাস ও রাজনৈতিক মেরুকরণ শীর্ষক) অবমুক্তির আয়োজনটি প্রকাশক মাধবপুরে করে লেখককে সুযোগ করে দিয়েছেন যাতে তিনি তার জন্মজনপদের মানুষ, প্রকৃতি তথা শেকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতার কিছুটা হলে ও স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হয়েছেন, ঋণ পরিশোধের প্রয়াস নিতে পেরেছেন। বিশেষ অতিথির ভাষণে অতিরিক্ত সচিব এবং বিটাক মহাপরিচালক বলেন যে প্রফেসর ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘ চার দশকের ও বেশী সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা ও নিবেদিত চিত্তে অধ্যয়ন করেছেন। দেশে বিদেশে এ বিষয়ে তার প্রচুর প্রকাশনা ছাপা হয়েছে যা বিভিন্ন মহলে দারুণ সমাদর পেয়েছে। মাধবপুরে সমাজ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে ও প্রেক্ষাপটে এ সমাবেশে তার বই দুটোর অবমুক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যথার্থ।
হাওর গবেষক সাইদুর রহমান তালুকদার বলেন যে জলবায়ু পরিবর্তন বইটিতে ‘কালিদহ সায়র ও সিলেটে ভূমিকম্প’ শীর্ষক নিবন্ধটিকে অন্তর্ভুক্ত করে লেখক একটি সুপরিচিত অথচ বিলীয়মান কিংবদন্তিকে পুন:জাগ্রত করার প্রশংসনীয় প্রয়াস নিয়েছেন। হাওর নিয়ে তার গবেষণায় ও সিলেটে ভূমির রূপান্তরে ভুমিকম্পনের প্রভাবের সন্ধান জোরালো ভাবে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। হবিগঞ্জ বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল, প্রিন্সিপাল মোঃ জহির উদ্দিন এবং আন্দিউরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আতিকুর রহমান প্রমুখের বক্তব্যে ও মাধবপুর উপাজেলায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে পরিবেশ বিপর্যয়, বিশেষত নদী-খাল-বিল স্রোতধারা মরে যাওয়ার করুন অবস্থার কথা জানান ।
হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শাহীদ উদ্দিন চৌধুরী জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের যোগসূত্র এবং মাধবপুরে এর প্রাসঙ্গিকতা টেনে বলেন যে মার কোম্পানির শাহপুরের পরিবেশ দূষণ কারক কারখানাটির কারণে বিস্তীর্ণ এলাকার হাঁস, মুরগিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ ইত্যাদি যখন বিলোপ হয়ে যাচ্ছিল, কারখানাটির নিঃসৃত বর্জ্যের দুর্গন্ধে ও বিষক্রিয়ায় জনজীবন যখন অতিষ্ঠ হওয়ার পর্যায়ে তখন সফল আন্দোলন এবং সরকারে বিভিন্ন সংস্থা, স্থানীয় সর্বকর্মের নেতা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমস্যাটির সমাধান সম্ভব হয় । আনন্দের কথা মাধবপুর থেকে অলিপুর শিল্প পার্ক এলাকায় ত্রিশের ও বেশী শিল্প কারখানা এ উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বা সচেতনতার সাথে উন্নত প্রযুক্তি ব্যয়ভারে পরিবেশ দূষণ বহুমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে । মাধবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান এসএফএএম শাহজাহান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল, ভূর্জপত্রের প্রকাশক আব্দুল মমিন খান, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিন্টু চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার রোয় প্রমুখ মাধবপুরের বনজ সম্পদ, চা বাগান, পাহাড়, নদী, খাল-বিল, ছড়া এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত নিসর্গকে বাঁচিয়ে রাখতে সকল মহলের যৌথ প্রচেষ্টার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন পরিবেশ সংরক্ষণে তার সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মাধবপুর থেকে ফিরে এসে টাইম ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক সংখ্যা হাতে নিয়ে Climate Goes Private (April 25/ May 2,2022) নিয়ে দেখি মাধবপুরে বারবার উচ্চারিত আশাবাদ , প্রতিজ্ঞা , কৌশল যেন বা প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রবন্ধটিতে । মূল বক্তব্য হলো : বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী এবং সরকারি, বেসরকারি সহযোগিতা এবং সৌহার্দমূলক অংশগ্রহণ কাঠামোতে পুঁজিবাদী সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকানো সম্ভব। ২০২১ সালে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘ আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার জন্য যে ক্লাইমেট কনফারেন্স হয়ে গেল তাতে প্রথমবারের মত ব্যবসা ও শিল্প জগতের বিরাট সংখ্যক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এবং তাদের খোলামেলা প্রতিশ্রুতি সকল মহলে আশার সঞ্চার করেছে । জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি, প্যারিস চুক্তির একজন মুখ্য প্রণেতা লরেন্স তুবিয়ানার (Laurence Tubiana) মতে নতুন আবহ ও বাস্তবের সূচনা করেছে ।
এ প্যারাডাইম ও ফ্রেমওয়ার্কে ব্যবসা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিপতি, এবং সরকার একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃত দুষ্ট ক্ষতটিকে উপড়ে ফেলবে । বিজ্ঞান ওঁ প্রযুক্তি পুঁজিবাদ তথা মুনাফা অর্জনকে প্রভাবিত করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে হবে এ ধারনা এখন পুঁজিবাদী আধুনিক বিশ্বে স্বীকৃত ধারণা । একই সাথে দুটো অর্জন- জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সফল ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগে মুনাফা অর্জন -এ দ্বিবিধ লক্ষ্য এখন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সম্মত ধারণা যা আমাদের আয়ত্তের মাঝেই আছে তার যথাযথ এবং যথাশীঘ্র ব্যবহারে প্রাইভেট সেক্টর এবং সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা এখন সময়ের দাবী এবং তা অর্জনে অগ্রগতিও হচ্ছে সত্য ও পরম তুষ্টির ব্যাপার। যথার্থভাবেই এবারের আর্থ ডে বা ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয়েছে “ইনভেস্ট ইন আওয়ার প্ল্যানেট।”
Posted ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh