মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
জাতি মহৎ হয় তখনই যখন জাতির প্রতিটি মানুষ হয় মহৎ। গণতন্ত্র আছে বলেই আইনের শাসন আছে আমেরিকায়। গণতন্ত্র আছে বলেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থেকেও হেরে গেলেন। অভিনন্দন জো বাইডেন-অভিনন্দন কমলা হ্যারিস। আমেরিকাকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রের দেশ। কারন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর যার যার পরিধি ও ক্ষমতা বিস্তারিত ভাবে সংবিধানে দেয়া আছে। আদোতে সেই নিয়মেই আমেরিকা চলে আসছে শত বছর ধরে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নির্বাচন হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সারা বিশ্বে যত উৎসাহ উদ্দিপনা আলোচনা দেখা যায়, তা আর অন্য কোন দেশের ভোট নিয়ে হয় না। আমেরিকান ভোটাররা মুলত ভোট দিয়ে ইলেক্টোরাল ভোটার নির্বাচন করেন। তারাই চূড়ান্ত ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে থাকেন। দেশটিতে মোট ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮টি। মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্য গুলোর জন্য ইলেক্টোরাল ভোট নির্দিষ্ট করা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের প্রয়োজন পরে।
আমেরিকান ফাউন্ডিং ফাদারগণ এই দেশকে যেভাবে সাজিয়ে গেছেন, সেভাবেই চলে আসছে এই দেশ। আমেরিকার সৃষ্টির পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন প্রেসিডেন্ট বা তাঁর দল সেই সংবিধান নড়াতে পারেনি। ফলে সেই সংবিধানকে সবাই সম্মান করে চলেছেন আজও। ইচ্ছা করলেও কেউ তা নাড়াচাড়া করতে পারছেন না। এদেশের শত বছরের গণতন্ত্রের ঐতিহ্য চলে আসছে আজও। আমেরিকার গণতান্ত্রিক ধারা এতটা শক্তিশালী এটিকে কেউ ক্ষতি করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদারগণ এই দেশকে অন্তর দিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবেসে গেছেন। এ পৃথিবীও এত ভালোবাসা ধারন করতে পারবে না। এ সংবিধান একদিনে তৈরি হয়নি। দিনের পর দিন বছরের পর বছর তাঁরা দেশকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে আজকের এই আমেরিকা। ফাউন্ডিং ফাদারগণ খুব ভেবে চিনতে এই দেশকে এমন ভাবে সাজিয়েছেন। সারা বিশ্ব তাই আমেরিকাকে নিয়ে ভাবছেন। প্রথম প্রথম আমেরিকার ইলেক্টোরাল কলেজ নিয়ে ভাবতাম। হিলারী ক্লিনটন পপুলার ভোটে ৩ লাখ ভোট বেশি পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেলেন। ভাবতাম এ আবার কেমন গণতন্ত্র। এখন দেখছি ফাউন্ডিং ফাদারদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আজ যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প পপুলার ভোটে বিজয়ী হতেন, আমেরিকার অবস্থা কেমন হতো। কোথায় যেত আমেরিকা। ট্রাম্প একজন স্বৈরশাসকে পরিনত হতেন। তাঁকে কন্ট্রোল করার মতো আর কেউ থাকতো না। হিটলারী কায়দায় দেশ চালাতেন। এই দেশকে কোথায় নিয়ে যেতেন কে জানে।
দেশে যাতে করে কোন স্বৈরশাসকের আবির্ভাব না হয়, গণতন্ত্রের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, এই জন্যেই ফাউন্ডিং ফাদারগণ এর ব্যালেন্স করার জন্য ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের প্রবর্তন করেন। এটি এমনি এমনি হয়নি, অনেক প্রয়োজনে ভেবে চিন্তে তাঁরা করে গেছেন। এর পিছনে তাঁদের কোন স্বার্থ ছিলোনা। দেশের স্বার্থই তাঁরা বড় করে দেখেছেন। যে প্রার্থী যে স্টেটে হেরে যাবেন তিনি আর ঐ স্টেটের ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন না। ৫৩৮ টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০ টি পেলেই সে জয়ী।
সেখানে এই পর্যন্ত বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬ টি ইলেক্টরাল ভোট আর ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২ টি। এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক। ১২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে এবারের নির্বাচনে। ১৪ কোটিরও বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন এবারের নির্বাচনে। যার ভোটের সংখ্যা ৫০.৮ শতাংশ পড়েছে বাইডেনের পক্ষে আর ৪৭.৮ শতাংশ ভোট গিয়েছে ট্রাম্পের নামে। ট্রাম্প পেয়েছেন ৭৩ মিলিয়ন আর বাইডেন পেয়েছেন ৭৮ মিলিয়ন ভোট। সিএনএনের তথ্যমতে জো বাইডেন পেয়েছেন ৭ কোটি ৯২ লক্ষ ৪৮ টি আর ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ৭ কোটি ২৬ লক্ষ ৯ হাজার ৯২৫ টি পপুলার ভোট।
ট্রাম্পের গত ৪ বছরের শাসন ছিল কুশাসন আর স্বৈরাচারীতা। বিশ্ব নেতার আসনে বসে আমেরিকাকে হাসির পাত্রে পরিনত করেছেন। দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বিশ্বের যেসব দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, স্বৈরশাসন চলছে, আমেরিকা বরাবরই তাঁর বিরুদ্ধে সচ্চার ছিল। আর এবার কি দেখলো বিশ্ব। ট্রাম্প হতাশ করলো বিশ্ববাসীকে। তাঁর আমলেই বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ট্রাম্প নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। কারে ধরে কারে খাবেন।
ট্রাম্প যত ভোটে তিনি হেরে গেছেন, পুনর্গননা সত্ত্বেও সেসব স্টেটে তার জয় পাওয়া যাবে না। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হার না মেনে তৃতীয় বিশ্বের কোন কোন শাসকের মত স্বৈরাচারী আচরণ করছেন। রিপাবলিকান পার্টির নেতৃবৃন্দের ভিতরেও এমন অগণতান্ত্রিক হাবভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এমন হলে তো আমেরিকা বিভক্তির দিকে এগিয়ে যাবে। এজন্যেই ফাউন্ডিং ফাদারদেরকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। সত্যিকার অর্থেই তাঁরা এ দেশকে অনেক দিয়ে গেছেন। তাঁদের তুলনা হয়না। জাতি তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। এমন এমন নেতা পৃথিবীতে বিরল।
আমেরিকার টপ সিকিউরিটি নির্বাচন কর্মকর্তা এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছেন, আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে এই বছর। নির্বাচনের ভোটিং সিস্টেমে কোন গড়মিল পাওয়া যায়নি। তাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোন অবস্থাতেই আর ক্ষমতায় থাকার উপায় নেই। জো বাইডেনের জয়ের এত বিশাল ব্যবধান তা উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক দেশে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অবশ্যই হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে যেতে হবে।
গণতন্ত্রের জন্যেই আমেরিকা এতটা শক্তিশালী। সেই শক্তিতেই আমেরিকা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই দেশে কেউ একক ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। যে যত জনপ্রিয় হউক না কেন, দুই টার্মের বেশি ইলেকশন করতে পারবেন না। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনিও দুইটার্ম দেশ শাসন করে চলে গেলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তাও তিনি পারলেন না। আমেরিকার সংবিধান তাঁকে এলাউ করলো না।
প্রথম দিকে একজন প্রেসিডেন্ট পর পর চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফাউন্ডিং ফাদারগণ ভাবলেন এমন হলে দেশ এক স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবেনা আর। এত বড় বিরাট দেশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দেশের স্বার্থে ফাউন্ডিং ফাদারগণ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, যে যত জনপ্রিয় হউক না কেন দুই বারের বেশি প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করতে পারবেন না। তখন থেকেই তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এটিই শেষ পর্যন্ত আইনে পরিনত হয়। সে নিয়মেই চলে আসছে এ দেশ। এ দেশের নেতারা দেশের জন্য অনেক চিন্তা ভাবনা করে গেছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর মূল্য আজ আমেরিকার জনগন পাচ্ছেন। গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বের বুকে আমেরিকা আজ সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী দেশে পরিনত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিদায় অনুষ্ঠান ছিল কতোনা বেদনা বিধুর। বিশ্বের হাজার হাজার কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে তাঁর বিদায় অনুষ্ঠান। পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। টেলিভিশনের পর্দায় কেঁদেছেন বহু মানুষ সাথে আমিও। বিশ্বের একজন ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করেই যেন ক্ষমতাহীন হয়ে গেলেন। এ দৃশ্য যারা দেখেছেন তাঁরা ভুলবেন না কোনদিন। এ দৃশ্য কখনো ভুলার নয়। আমেরিকান এয়ারফোর্স দেশের প্রেসিডেন্টকে শেষ স্যালুটটি দিয়ে শেষবারের মতো প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টারে উঠালেন। মনে হলো যেন তারাও কাঁদছেন। অশ্রুর ধারা বয়ে যাচ্ছে সকলের, ধরে রাখতে পারছেন না তারাও। বারাক ওবামার হেলিকপ্টারটি আকাশে উড়াল দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, কোটি কোটি আমেরিকানদের হৃদয় ছিড়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। বহু মানুষের চোখের জ্বল গড়িয়ে পড়ছিল। “নেতা, যেতে নাহি দিব হায়, তবু চলে যায়”। সেই দিনটির স্মৃতির কথা মনে করে আজও যেন আমার অশ্রুর ধারা কাগজের উপর টপটপ করে পড়ে। আমার লেখা অদৃশ্য হয়ে যায় চোখ থেকে।
একেই বলে আমেরিকা ও তাঁর গণতন্ত্র। কি সুন্দর দেশ। এদেশকে ভালো না বেশে কি পারা যায়। একে সম্মান করে দেশের প্রতিটি মানুষ। এদেশের নেতারা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটি আগে দেখেন। নেতাদের কাছে দেশের প্রতিটি মানুষ কতো না মূল্যবান। এ দেশে নির্বাচন হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, কিন্তু কেউ কারোর শত্রু নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ কি করলেন। দেশকে উস্কে দিয়ে বিভাজন সৃষ্টি করে গেলেন। আমেরিকার যে ইউনিটি, আমেরিকার যে শক্তি, তিনি তা নষ্ট করে গেলেন। বিশ্ব দরবারে আমেরিকার ইমেজকে হেয় প্রতিপন্ন করলেন। তাঁর জন্য এ ক্ষতি অনাদিকাল বয়ে বেড়াবে আমেরিকা।
ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার কালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একটি চিঠি রেখে যান তাঁর টেবিলে। তাতে লেখা, “অভিনন্দন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তোমার জন্য শুভকামনা রইলো আমার। আমেরিকার জনগণকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। তুমি তাঁদেরকে রক্ষা করবে। বিশ্বের অশান্তি নির্মূল করার বিশাল দায়িত্ব তোমার উপর। তোমার সঠিক দিক নির্দেশনা আমেরিকাকে সমুজ্জ্বল করে রাখবে”। ইতি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বিদায় কালে সর্বপ্রথম চিঠি লিখে যান তাঁর উত্তরসূরির কাছে। পরবর্তীকালে সেই ধারা অব্যহত রাখেন পরবর্তী প্রেসিডেন্টগণ এমনিভাবে চিঠি লিখে। এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি লিখে যান তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন দেশের জনগন। এটিই এদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
Posted ১০:০২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh