ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ : | বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
ইরানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী জনমনে দারুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পারস্য সাম্রাজ্য এতোই পরাক্রান্ত ছিল যে গ্রীক বীর আলেক্সজান্ডার দি গ্রেট এখানে সুবিধে করতে পারেননি। অপরাজেয় এ সাম্রাজ্যের কাছে নতি স্বীকার করে থাকতে হতো আসেপাসে জনপদ, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যগুলোকে। আধুনিক যুগে পদচারনা করলে প্রথমে ব্রিটিশদের কুটকৌশলে এবং এক পর্যায়ে আমেরিকার হাত মিলানোর ফলস্রুতিতে শাসক বদলে যায়। তাদের অনুগত পাহলবি বংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পাহলবি শাহ উপাধিধারী অধিপতিরা প্রচণ্ড প্রতাপে সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করে। জনবিচ্ছিন্নতা, পাশ্চ্যাতের সাথে অত্যধিক ঘেঁষাঘেঁষি, উচ্চ হারে ট্যাক্স এবং নানা ধরনের ইসলাম বিরোধী কাজ রেজা শাহ পাহলবিকে অপ্রিয় করে তোলে। আমেরিকার সাথে দহরম-মহরম ইরানের মোল্লা গোষ্ঠী মোটেও মেনে নিতে পারেনি। শাহের কূখ্যাত গুপ্তচর বাহিনী সাভাকের ভয়ে এরা ঘাপটি মেরে বসে ছিল।
শিয়া ধর্মীয় নেতাদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গিয়ে শাহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আয়াতুল্লাহ খোমেনীও বিদেশে আত্মগোপন করে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের সাফল্যে রাজতন্ত্র উৎখাত করার ফলশ্রুতিতে শাহানশাহ উপাধিধারী মোহাম্মাদ রেজা পাহলভি (১৯১৯-জুলাই ১৯৮০) পালিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। পাহলভী বংশের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ শাহ ইরানে পশ্চিমা ধারার আধুনিক জীবন ধারার প্রবর্তন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পতিত শাহের সবচেয়ে বড় পুত্র যুবরাজ রেজা পাহলভি গত ৫০ বছর যাবত প্যারিস ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি নিউক্লিয়ার জ্বালানী পরিশোধনের গোপন জায়গায় বোমা মেরে ধ্বংস করেছে ঘোষণা দিলে যুবরাজ ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়েছে মনে করে বেশ তৎপরতা শুরু করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যেকার সম্পর্ক দ্রুত অবনতির পথে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর ক্ষমতা দখল মূলত দায়ী হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, তেল বাণিজ্য কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তার আদর্শ এবং বাসনা ও কাজ করেছিল। ইরান-কণ্ট্র ইস্যু বড় একটি কণ্টকময় ব্যাপার ছিল। নয় বছরব্যাপি ইরান-ইরাকযুদ্ধ দুটি শক্তিশালী মুসলিম দেশকে লক্ষণীয়ভাবে দুর্বল করে দেয়। ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেন ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিলে ও লিবিয়ার গাদ্দাফি নিহত হওয়াসহ পথের কাঁটা দূর হয়। আরব বিশ্বে শিয়া-সুন্নি বিভেদকেও জুতসই ভাবে কাজে লাগানো হয়।
শ্বেত বিপ্লবের সুফল ইরানের সাধারণ জনসাধারণ ভোগ করতে পারেনি। তার আগেই বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তি ইসলামিক বিপ্লবের কাছে পরাভুত হয়। শাহের পশ্চিমা মিত্ররা তাকে জানিয়ে দেয় যে ইরানের রাজতন্ত্র রক্ষার আর কোন উপায় নেই। গত্যন্তর নাই দেখে রেজা শাহ পাহলভি ১৯৭৯ এর জানুয়ারি মাসে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
এর পরবর্তীতে ইরান, ইরাক তথা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যে অশান্ত রাজনৈতিক আবহাওয়া তাতে আমেরিকা এবং রাশিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে আমেরিকা এবং তার মিত্রপক্ষ যোগ দিলে রাশিয়া ইরান এবং সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবব্ধ হয়। তুরস্কের কুর্দিদের একাংশ আমেরিকার সাথে যোগ দেয়। ইরান দক্ষিণ লেবাননে ঘাটি করে হিজবুল্লাহ বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে। ইসরায়েলে নিত্য হানা দিলে বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রটি দক্ষিণ লেবাননে পাল্টা হামলা করতে থাকে। আইডিএফ পরিকল্পিতভাবে হামলা, পাল্টা হামলা চালালে এক পর্যায়ে বৈরুতে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ নেতাদের পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করতে থাকে ইসরায়েল। আসাদের পতন হলে সিরিয়া, দক্ষিণ লেয়ানন ইসরায়েল বাধাহীনভাবে ইরান সমর্থিত সকল পক্ষকে কোণঠাসা করে ফেলতে সমর্থ হয়।
ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুতি দল হম্বিতম্বি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের নৌ প্রতিরোধের মুখে সুবিধে করতে পারেনি। বস্তুনিষ্ঠ মুল্যায়নে প্রতীয়মান হবে যে ১৯৭০ এর দশকে জর্ডানের বাদশাহ অত্যন্ত নির্মমভাবে তার পাকিস্তানি প্যালেস গার্ড ব্যবহার করে তাবুতে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিদের কচুকাটা করেছিলেন। লেবাননে পালিয়ে গিয়ে এরা যে অশান্তির জন্ম দিয়েছিল তা দেশটিকে দীর্ঘ মেয়াদি সিভিল ওয়ারের দিকে নিয়ে যায়। পরিণতিতে ইরান চরম শিয়াপন্থী হিজবুল্লাহ বাহিনী প্লান্ট করে। লেবাননের দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাএর রুখতে অপারগ হলে সময়ে সময়ে ইসরায়েল এদের বিরুদ্ধে খোদ বৈরুত এসে অভিযান চালায়। আরব দেশগুলো তিন তিনবার যুদ্ধ করে সুবিধে করতে পারেনি ।
পরন্তু গোলান হাইটস এবং সিনাই দখল করে নেয়। ২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪, এবং ২০২১ এর পরম্পরায় ২০২৩ এর ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধে প্রায় ২০০০ ইসরায়েলি এবং ৫৫ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে। সাম্প্রতিক খবরে জানা গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৬০ দিনের মেয়াদের এক যুদ্ধ বিরতির প্রস্থাব দিয়েছেন যা দু পক্ষই মেনে নিবে বলে মনে হচ্ছে।
Posted ১২:৪৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh