আশরাফ উদ্দিন আহমেদ : | বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩
স্বেচ্ছায় বেছে নিলে ও অভিবাসন জীবন অনেকের কাছে দীর্ঘস্থায়ী মনোবেদনা। জৌলুস আর বৈভব পূর্ণ জীবন যাপনে ও মনের গভীরে নিরন্তর ব্যাথা তাড়না করে। এ একধরনের মানসিক ব্যাধি, দুর্বিষহ একাকীত্ব, এবং নির্জন অস্তিত্ব। আমার মত অত্যধিক সংবেদনশীল অভিবাসীকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে রাখে সবসময়। অনাথ হলে যেমন বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করে, অসহায় অবস্থার অনুভুতি ও কষ্ট দেয় তেমনি বিদেশ অবস্থান ও মনকে পীড়ন করে অহরহ। জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারি যে কোন সময় কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক গ্রন্থি আস্টেপৃষ্টে বেঁধে এমনি এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যা থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব ।
মাতৃভূমির জন্য যে মায়া তা নাতি-নাত্নি পরিবেষ্টিত হয়ে যাওয়ায় এ স্নেহ বন্ধন বেষ্টনী দুর্ভেদ্য প্রায় । মা-বাবা গত হয়েছেন অনেককাল হল । শেকড় ক্রমেই আলগা হয়ে যাচ্ছে । তাও, যাকে বলে মাটির টান, তা ভীষণভাবে আকর্ষণ করে চুম্বকের মত। তৃপ্তি-অতৃপ্তি প্রশ্নে মাতৃভূমি বনাম স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া দেশ নিয়ে তুলনায় প্রথমটি নিয়ে সুসংবাদ শুনলে যে আনন্দ পাই তা অভিবাসিত দেশ সম্বন্ধীয় হলে পাইনা। বিত্ত, নিরাপত্তা এ সব নিরিখে তুলনামূলক ভাবে মাতৃভূমির চেয়ে স্বস্তিকর হলে ও সেই ফেলে আশা দেশটির প্রতি মমত্ব অনুভব করি শত সহস্র গুণ বেশী। বাংলাদেশের অর্জন বিমোহিত করে, দুর্গতি মর্মে আঘাত হানে প্রচণ্ড ভাবে।
অভিবাসন যে জীবন প্রবাহ, ধারা আর রুটিন জীবনে অবরুদ্ধ করে তা স্বাভাবিক জীবন নয়। বৈভব, প্রাচুর্য, সুনসান বাড়ী-গাড়ী, দামী পোশাক-পরিচ্ছদ, পার্টি ইত্যাদি কিছুই সত্যিকার তৃপ্তি নিয়ে আসে না । এসবের আহ্বান, আনন্দে নিমজ্জন স্বাভাবিক জীবনের আনন্দ নয়; মনে হয় কি যেন এ সবে নেই! জন্মভূমির সাথে যে প্রেম তাই সত্যিকার প্রেম, বাদবাকি সব যতই জৌলুসে ভরপুর হোকনা তা শুধু অনুরাগের অভিশাপ আর সঞ্চিত ব্যাথা ।
অভিবাসিত জীবনে উপভোগ আছে কিন্তু তাতে প্রশান্তি মেলেনা। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস, সে যে কারণেই হোক, নির্বাসন, রিফুজি, অভিবাসী মানুষ মনসুখের সামান্যতম অনুভূতি ও পায়না । এরা দু’ দুনিয়ায় বসবাস করে। ছেড়ে আসা জন্মভূমিতে মন পরে থাকে কিন্তু সেখানে যে আর আগের মত আদৃত নয়, সংপৃক্ত নয় তা সে জানে। বিদেশে কষ্টে উপার্জিত আয়ে ভাগ বসানো, ফেলে আসা সম্পদ ভোগ করা, এমনকি ছলে, বলে, কৌশলে জমি-জমা আত্মসাত করা শুরু হলে কিছুটা টনক নড়ে বটে কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি মায়ায় তেমন ছেদ পরে না। আত্মীয় স্বজনদের প্রয়োজনের কথা ভেবে, দারিদ্র থেকে মুক্তির দোহাইকে যৌক্তিক মনে করে এসব দুষ্কর্ম ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
সব কিছু ছাপিয়ে যে বাস্তব প্রবাসী সত্ত্বাকে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত করে, হৃদয় মনকে বেদনা ভারাক্রান্ত করে রাখে তা হল বিচ্ছিন্নতা বোধ। একজন প্রবাসী দুই জগতের বাসিন্দা। কোনটাতেই মানসিকভাবে স্থিত অবস্হায় নন। দু’ জগতেই আগন্তুকের মতোন । তিনি যদি বুদ্ধিজীবী হোন তাহলে দু সংস্কৃতির ভুবনে অবস্থিতির কারণে কোনটার সাথেই একাত্ম হতে পারেননা । এডওয়ার্ড সাইদের (Edward Said) ‘Reflections on Exile প্রবন্ধটির পর্যালোচনা প্রসঙ্গে সম্পাদকদ্বয় বলেন তাদের মনের যে অবস্থা একজন অভিবাসী হিসেবে তা তুলনা করা যেতে পারে জেমস জয়সি এবং দান্তে’র সাথে, দেখুন, (Stuart Hirschberg and Terry Hirschberg in Past to Present Ideas that Changed Our World, Prentice Hall 2003, pp303-304) । প্রথমোক্ত জন আয়ারল্যান্ড থেকে এবং দ্বিতীয়জন ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন ।
তারা দুজনেই “dispossessed intellectual” এবং সে কারণেই নিজেদের দেশ, সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রোধ আর শোকে ম্রিয়মাণ অবস্থায় জীবন কাটিয়েছেন । সাইদের মতে, … the possibility that those who live as outsiders in a culture to which they have emigrated may achieve a level of detachment akin to that of a religious ascetic who has transcended worldly attachment (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০৪)। দেশত্যাগ করার পেছনে যে কোন কারণই থাকুক না কেন, বহিষ্কারাদেশ, নির্বাসন, আইনানুগ অভিবাসন তা সাধারণত স্বদেশের ভূমি, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, জন্ম থেকে পরিচিত প্রকৃতি ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক ফিলিস্তিন বংশোদ্ভুত এডওয়ার্ড সাইদ বলেন, স্বদেশহারা যারা তারা যুগপৎ সদা সর্বদাই ক্লান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত, প্রাণে প্রশান্তি নেই এমন মানুষ । এ অবস্থা হলে মানুষ ঋতু বৈচিত্র্য ভুলে যায় ; শীতের জড়সড় আড়ষ্টতা তাদের ঘিরে থাকে । এ রকম শীতমন অনুভূতিতে গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্ত, বসন্তকাল হৃদয়ে উষ্ণতা, প্রেম, ভালবাসা নিয়ে, উৎফুল্ল বোধ নিয়ে হাজির হয়না । ঋতু চক্রের ভিন্নতা সত্ত্বে ও অভিবাসীদের মনে ক্ষণিকের জন্য অনুরাগ, উচ্ছ্বাস, প্রেমানুভুতি আসে কিন্তু তা ম্লান হয়ে যায় ফেলে আসা স্বদেশের কথা মনে আসলে ।
Posted ৪:০৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh