শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

আমেরিকায় আত্মহত্যা ও একজন মারুফ বিল্লাহ

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু :   |   বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২

আমেরিকায় আত্মহত্যা ও একজন মারুফ বিল্লাহ

মারুফ বিল্লাহ ২৩/২৪ বছর বয়সী তরুণ। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে সে আত্মহত্যা করে। ওর আত্মহত্যার খবর পাওয়ার পর আমার মনে হয় আত্মহত্যা করার জন্যই সে আমেরিকায় এসেছিল। বাংলাদেশ থেকে আসার সঙ্গত কারণ ছিল না তার। সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। বেশি পড়াশোনা করেনি। দেশে পারিবারিক ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তবুও তারুণ্যের উন্মাদনা, অভিযাত্রার নেশা, বন্ধুদের উৎসাহে ২০১৩ সালে সে স্বপ্নের দেশের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিল। বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করে ডজনখানেক দেশের নদী জঙ্গল অতিক্রম করে অবশেষে মেক্সিকো হয়ে আমেরিকার সীমান্ত অতিক্রম করে। বর্ডার এজেন্টরা তাকে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠায় এবং সেখান থেকে ইমিগ্রেশনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষে ছেড়ে দিলে নিউইয়র্কে চলে আসে এবং আমেরিকায় স্থায়ী বৈধতা পাওয়ার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ট্যাক্সি চালানোর কাজ করে ভালো আয়-রোজগার করছিল। তার পরিচিত একজনের কাছে আমার কথা শুনে ইমিগ্রেশনের অবশিষ্ট প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন করবে সেই পরামর্শ নিতে আমার কাছে আসে। আমাকে ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন শুরু করে, অল্পক্ষণের মধ্যে ‘ভাই’ এ নেমে আসে। ওর চেয়ে বয়সে তিনগুণ বড় হলেও আমাকে নাকি ‘আঙ্কেল’ ডাকতে ওর ভালো লাগছিল না। আমাকে জোর করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ায়। সেদিন আমার জ্যাকসন হাইটস যাওয়ার কথা, সন্ধ্যায় আমাকে সেখানে নামিয়ে দেয়। ওর ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র নিয়ে শিগগির আসবে জানিয়ে চলে যায়।


মারুফের সাথে দেখা হওয়ার পর এক মাসও কাটেনি, আলমগীর ফোন করে জানালো মারুফ সুইসাইড করেছে। যে বাড়ির একটি রুমে সে থাকতো সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ায় বাড়ি মালিক পুলিশকে খবর দেয় এবং পুলিশ এসে তারা প্রায় গলিত ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে। এটি আমার পরিচিত কারো আত্মহত্যার একমাত্র ঘটনা। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা ডাইজেস্টের উদ্বোধনী সংখ্যায় বাংলাদেশের ওই সময়ের সবচেয়ে আত্মহত্যা-প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত ঝিনাইদহের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকের পবেষণা ফলাফল প্রকাশ করেছিলাম এবং পরবর্তীতেও খোঁজখবর নিয়ে ওই এলাকার এক শ্রেনির মানুষের স্পর্শকাতরতার কথা জেনে হতবাক হয়েছি। স্বামী খেতে বসে স্ত্রীকে বললো তরকারিতে এত লবন কেন, বা বেশি ঝাল কেন, স্ত্রী চুপচাপ ওঠে গিয়ে শোবার ঘরের দরজা আটকে দেয়। ডাকাডাকির পর যখন দরজা খোলে না, পরিবারের লোকজন দরজা ভেঙে বা বেড়া কেটে ভেতরে গিয়ে ওই মহিলাকে ঘরের আড়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় লটকে থাকতে দেখা যায়। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার কারণে কিশোর ছেলে বা মেয়েকে বকাঝকা করলে তাদের মৃতদেহ বাঁশঝাড়ে বা ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখা যায়। দীর্ঘ চিকিৎসায় কারো রোগব্যাধি নিরাময় না হলে ক্ষেতে আলে বাসে কীটনাশক গিলে জীবন যন্ত্রণার অবসান ঘটায়।

মারুফের আত্নহত্যার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? আলমগীরের কাছে জানতে পারি, ঢাকায় এক মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমিক প্রেমিকা হোক, স্বামী-স্ত্রী হোক; দূরত্ব ও দীর্ঘ অনুপস্থিতি নানা সংশয়ের জন্ম দেয়। উভয় পক্ষই উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে কারো না কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট, এমনকি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ আনে। এসব নিয়ে তুমুল কলহ সৃষ্টি হয়, অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটে, প্রেমিক-প্রেমিকার ছাড়াছাড়ির মধ্যে দায়বদ্ধতা থাকে না। সবল মনের তরুণ তরুণীরা একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরতে পারে। মারুফ তার বয়স বিশ পেরুনোর আগেই প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে, নি:সন্দেহে সে সাহসী ছিল। কিন্তু প্রেমিক হিসেবে অতি-স্পর্শকাতর ছিল। এই স্পর্শকাতরতা তাকে নিজের জীবন নেওয়ার মতো দু:সাহসী করে তুলেছিল। আলমগীরের বর্ণনা মতে, মারুফ আট হাজার মাইল দূরে ঢাকায় অবস্থানরত প্রেমিকাকে ভিডিওতে রেখে গলায় রশি দিয়ে বাড়ির সিলিং থেকে ঝুলে জীবনের যবনিকা টেনেছে। মারুফের সাথে মাত্র একদিন কয়েক ঘন্টার জন্য আমার দেখা হয়েছে, কিন্তু ছেলেটির হাসিমুখ এখনো ভুলতে পারি না, কষ্টও অনুভব করি।


মারুফের কথা ভেবে আমার যখন এই অবস্থা, যারা তাদের প্রিয়জনকে আত্মহত্যার শিকার হতে দেখেন, তাদের মনের অবস্থা কি হতে পারে তা অনুমাদন করতে পারি। আমার পরিচিত কয়েকটি পরিবারে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তাদের নাম উল্লেখ করে তাদের ক্ষতে আঘাত দিতে চাই না। “আত্মহত্যা মহাপাপ’ কথাটি শৈশব থেকে শুনে আসছি, সকল বড় ধর্মে একথাই জোর দিয়ে বলা হয়, কিন্তু আত্মহত্যা বন্ধ হয় না। পাপ-পূন্য চিন্তা কি মানুষের মনে এতটা প্রভাব ফেলে? প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থ বুঝে কাজ করে, এমনকি অধিকাংশ ধর্ম চর্চাকারী ধর্মের প্রদর্শনমূলক প্রার্থনাগুলো সম্পন্ন করলেও আড়ালে তাদের আস্তিনের সাপ বের করে আনে, অর্থ্যাৎ ‘চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি।’ কার ওপর কাঠামোর ভেতরে কি তা কেউ জানে না। কালই খবর দেখলাম, হবিগঞ্জের এক ব্যক্তি স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা করে মসজিদে গেছেন নামাজ পড়তে।

একজন মানুষের মনের মধ্যে কি চলছে, তা আরেক জন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কেউ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না যে কি কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে তাকে তার নিজের জীবনের ইতি টানতে হবে। আত্মহত্যাকারীর ঘনিষ্টরা হয়তো কিছুটা ধারণা করতে পারেন। আমেরিকান গবেষকদের মতে, এমন অনেক মানুষ আছে, যারা ভাবেন যে তারা মৃত্যুর ছায়ায় ঢাকা এক উপত্যকা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে জীবনের চরম অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব বলে মনে করেন এবং এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তিলাভের সহজ উপায় হিসেবে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।


আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যার প্রবণতাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা বলেন, “পাবলিক হেলথ ইস্যু” এবং উন্নত দেশগুলোতে কারো মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা রয়েছে জানা গেলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এবং সরকারগুলো এ খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। এতে কতটুকু কাজ হয় তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা শপিং মলে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করে বহু সংখ্যককে হত্যা করে নিজেই তারা মাথায় বা বুকে ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে মরে গেল। তার জন্য হয়তো মৃত্যুর আগে এটি কৃতিত্বপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার ছিল, কিন্তু নিহতদের পরিবারের কাছে চিরদিনের দু:খের স্মৃতি হয়ে থাকে তাদের প্রিয়জনকে হারানোর এই ঘটনা।

আত্মহত্যায় সারা বিশ্বে প্রতিবছর আট লাখ লোক মারা যায় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক আত্মহত্যা ঘটনা ঘটে ভারতে, যেখানে ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩ জন। চারটি রাজ্যের হিসাব অনুযায়ী মহারাষ্ট্রে ২২,২০৭, তামিলনাড়ুতে ১৮,৯২৫, উত্তর প্রদেশে ১৪,০৬৫ এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৩,৯৬৫ জন ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার তুলনায় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যাকারী মানুষের সংখ্য্া ভারতে আত্মহত্যকারীদের সংখ্যার মতোই অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ৪৬,০০০ লোক। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্টোল এন্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পরিসংখ্যান আরো সুক্ষ্ম, তাদের মধ্যে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যার চেয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবে, এমন সংখ্যা অনেক বেশি এবং ২০২০ সালে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছে ১ কোটি ২২ লাখ আমেরিকান, আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিল ৩২ লাখ আমেরিকান এবং আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল ১২ লাখ আমেরিকান। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে জাপানও পিছিয়ে নেই। ২০২১ সালে জাপানে ২১,০০৭ জন লোক আত্মহত্যা করেছে।

বাংলাদেশে আত্মহত্যার ওপর সাম্প্রতিক কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায় না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ওই বছর ১১,০৯৫ জন আত্মহত্যা করেছে, অর্থ্যাৎ প্রতিদিন ৩০ জন করে এবং সে বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বরিশালে, যে সংখ্যা ২,৫৮৫। এর আগে সর্বোচ্চ সংখ্যাক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে, তখন এ সংখ্যা ছিল ১৯,৬৯৭। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আট বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে মোট ৭৩,৩৮৯ জন, যার মধ্যে মহিলার সংখ্য্া ৪১,৫৩২। বেশির ভাগ মানুষ কীটনাশক এবং অন্যান্য বিষাক্ত তরল পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। বাকিদের অধিকাংশ আত্মহত্যা করেছে ফাঁসিতে ঝুলে।

ঝিনাইদহের আত্মহত্যাপ্রবণতার কথা প্রথমে উল্লেখ করেছি, আসলে ছোট্ট এই জিলায় আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতার চালচিত্র অদ্ভুত মনে হয়। এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে প্রায় প্রতিদিন একটি করে আত্মহত্যা ঘটে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল সময়ে ঝিনাইদহ জিলায় আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল ২২,৬৭৫ জন, যার মধ্যে আত্মহত্যা করেছে ৩,১৫২, এবং আত্মহননকারীদের ৭৭ শতাংশই নারী। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ বলা হয় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু বহু পরিবার তাদের কোনো সদস্যের এ ধরনের সমস্যা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না বলে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা ঠেকানো যায় না।

advertisement

Posted ১:৫৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(634 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.