মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
ট্রাম্প অবশেষে চলে গেলেন। কিন্তু অনেক খারাপ নজির জন্ম দিয়ে গেছেন। বিগত চার বছরে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে অশান্ত করে দেশের কোটি কোটি মানুষকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়ে ছিলেন। তিনি গত চার বছরের শাসনামলে আমেরিকাকে এক ঘরে করে ফেলেছিলেন। তার উদাসিনতার কারণে করোনায় চার লাখ মানুষের প্রাণ গেল। তিনি যে একজন বর্ণবাদী লোক তা প্রথম থেকেই বুঝা গেছে। ২০১৬ সালে তিনি নির্বাচনী প্রচারনায় আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ, ইমিগ্রান্ট, হিস্পানিক ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্যে বিষোদগার করতেছিলেন।
প্রথম থেকেই তার কথাবার্তায় বক্তৃতায় বৈষম্যবাদী আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। তখন থেকেই মূলত তিনি ইমিগ্রেন্টদের কৃষ্ণাঙ্গদের ও মুসলমানদের কোন ঠাসা করে বক্তব্য দিতে আরম্ভ করেন। মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন স্লোগানটি তার খুব কাজে লেগে যায়। এই কারণে তাকে পেয়ে শ্বেতাঙ্গরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা মনে করেন ট্রাম্পের মতো এমন নেতা ইতিপূর্বে আর কাউকে দেখেনি। এতে ট্রাম্প খুব সহজেই তাদের সমর্থন পেতে থাকেন। তাদের সমর্থন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই মেয়াদ হোয়াইট হাউজে থেকে আমেরিকাকে শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আদতে সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগুতে থাকেন এবং তিনি নির্বাহী আদেশে অনেক আইন চালু করেন। তার এই আদেশ শ্বেতাঙ্গ, ইজরাইলীদের শক্তিশালী করে তার সমর্থনের।
রিপাবলিকান পার্টির বেশীর ভাগই এই বৈষম্যবাদী নীতিতে বিশ্বাসী। তারাও সঠিক নেতা হিসেবে ট্রাম্পকে বেছে নিল। ট্রাম্প রিপাবলিকানদের বুঝাতে সক্ষম হন যে, তারা যেন ট্রাম্পকে সমর্থন দেন। তা না হলে এই দেশ সংখ্যালঘুদের দখলে চলে যাবে। শ্বেতাঙ্গবাদী রিপাবলিকানরা মনে করেন এত বছর পরে আমেরিকায় সঠিক নেতার আবিভাব হয়েছে। তারা এও মনে করেন ট্রাম্পের মত নেতার বিকল্প নেই। এই প্রবনতার ফলে আমেরিকার ৭ কোটি ৪২ লক্ষ ২২ হাজার ৯৫৮ জন তাকে ভোট দিয়েছেন। ট্রাম্পের জন্য এত সমর্থন বিষ্ময়কর ব্যাপার, যা অকল্পনীয়। ভাবতে পারেননি তিনি এত পপুলার ভোট পাবেন। ট্রাম্প একজন বিজনেসম্যান রাজনীতিবিদ নন। এত লোকের সমর্থন তার। কি ব্যাপার, কেন হেরে যাবেন? জো বাইডেনের কাছে ভোটে হেরে গিয়েও পরাজয় অস্বীকার করেন। তিনি ক্ষমতায়, তিনিই জিতবেন। দরকার হলে জোর করে বলপূর্বক জিতবেন। তবুও ক্ষমতা ছাড়বেন না। বিভিন্ন স্টেটে বহু গন্ডগোল লাগিয়েছিলেন তার সমর্থকেরা। তবুও কাজ হলো না। কারণ এটি আমেরিকা। বিশ্বের তৃতীয় দেশ তথা বাংলাদেশের মতো না যে, ক্ষমতায় থেকে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। আমেরিকায় তা করা গেল না ক্ষমতায় থেকেও। প্রথম প্রথম ক্ষমতায় এসে তিনি হিটলারি কায়দায় দেশ শাসন করতে আরম্ভ করেন।
তার এই আচরণ তার সমর্থকদের উৎসাহিত করে। তারা মনে করেন এই তো বাপের বেটা। তাকেই দরকার তাদের। ফলে ট্রাম্প দেশকে এক উশৃঙ্খলায় নিয়ে গেলেন। তিনিও তাই করেন। একজনকে হায়ার করেন তো ক’দিন পর ফায়ার করেন। পছন্দের মতো না হলেই তার বিরুদ্ধে লাগেন। কি এক হিটলারি ব্যাপার সেপার তার। যা ইচ্ছা তাই করতে পছন্দ করেন। গণতন্ত্রের ধার ধারেন না কিছুই। গণতন্ত্রের দরকার কি। তিনিই তো ক্ষমতায়। ওনার ইচ্ছাই তো শক্তি। এটি যে আমেরিকা, যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। তা তিনি মোটেও মানলেন না। তার গোঁয়ার্তুমির জন্য প্রথমবার ইম্পিচমেন্টের সম্মুখিন হলেন। তবে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। আবার যাবার কালে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হন তার সমর্থিত উগ্রবাদীদের ক্যাপিটল বিল্ডিং এ লেলিয়ে দেয়ার কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসে একজন কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না কখনোই।
গত ৬ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহবানে হাজার হাজার সমর্থক ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিলের সামনে সমবেত হয়। সেই দিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল ভোট সার্টিফিকেশন চলছিল। সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যৌথ অধিবেশনের সভাপতির আসনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ট্রাম্পের দলের। ট্রাম্প তাকে অনুরোধ করেন জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা না করতে। মাইক পেন্স তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সংবিধান তাকে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা দেয়নি, তিনি তা পারবেন না।
এই অবস্থা দেখে সেই দিনকার সমাবেশে ট্রাম্প তার সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলে লেলিয়ে দেন। পুলিশের ব্যারিকেট ভেঙ্গে প্রবল বেগে শত শত মানুষ ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে পড়ে, আমেরিকার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যয়ের সূচনা করে। বিক্ষুব্দ জনতা ভবনের দরজা, জানালা ভাংচুর করে। লুটপাট, তছনছ করে ফার্নিচার ফাইলপত্র। তারা অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে। তাঁদের খুজতে থাকে হত্যা করার জন্যে। এই ঘটনায় পুলিশসহ ৫জন ঘটনাস্থলে নিহত হয়।
ক্যাপিটল বিল্ডিং এ ঢুকে তাদের উদ্দেশ্য ছিল জো বাইডেনের ও কামানা হ্যারিসের নির্বাচনী ফলাফল বানচাল করা। ছবিতে দেখা গেছে প্রেসিডেন্টের সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবন একেবারে ঘিরে ফেলে। ভাগ্যের জোরে সিনেটরগণ, কংগ্রেসম্যানগণ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পিকার ব্যাঙ্কারে ঢুকে এতগুলো রাজনৈতিক নেতা প্রাণে বেঁচে যান। নইলে আমেরিকার ইতিহাস অন্যরকম হতো।
এই ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে কালো অধ্যয় হিসেবে রচিত হয়ে থাকবে। টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বের কোটি মানুষ এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছে। বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারকে হত্যা করে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করা। এই জন্যই মাইক পেন্স ও ন্যান্সি পেলোসিকে খুঁজতে ছিল তারা।
ভাগ্য ভালো ক্যাপিটল পুলিশ তাদেরকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলে। তা না হলে এতগুলো মূল্যবান মানুষের প্রাণ শেষ হয়ে যেতো। আমেরিকা কতটা ভাগ্যবান এই কারণে যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক সন্তানেরা বেঁচে গেছেন, যারা দেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন অবিরাম। তারা কতটা মূল্যবান, যারা দেশের প্রতিটি মানুষের কল্যাণে কাজ করে যান। এ দেশের নেতারা আমাদের প্রাণের চেয়েও বেশী, যাদেরকে আমরা ভালোবাসি। শুধু তাই নয়, এই প্যান্ডেমিকের কালে তারা আমাদের জন্য কিনা করেছেন। যাদের কল্যাণে আমরা এখনো বেঁচে আছি। এ কারণেই এই নেতারা আমাদের প্রাণ। হউক না তারা ডেমোক্রেট অথবা রিপাবলিকান। ট্রাম্প মোটেও ভাবলেন না এ মানুষগুলোর কি হবে। এখানে আছেন তার দলেরও লোক। এ কারণেই ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় ডাকা হয় তাকে। আমেরিকার ভাগ্য ভালো এমন ভয়ঙ্কর মানুষটি এখন আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নয়। তার নানা অপকর্মের বিচার হউক, জনগণ তা দেখতে চায়। এ জন্যে কংগ্রেসের ভোটে সে ইমপিচ হয়।
এই দেশটিকে আমরা ভালোবাসি। এ দেশের ক্ষতি হউক আমরা কেউ তা চাই না। ২০শে জানুয়ারি অভিষেকের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতাসীন হন। তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসের নেতৃত্বে আমেরিকা আবার সঠিক পথে ফিরে আসুক। তাঁদের কল্যাণে সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক, এই কামনা করে এ দেশের মানুষেরা। আমেরিকান জাতি আজ এমন একজন নেতা পেয়েছে, যিনি সাড়া জীবন পরিশ্রম করেছেন মানুষের কল্যাণে। নূতন করে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁর এ যাত্রা শুভ হউক, সুন্দর হউক, স্বার্থক হউক, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ হউক। এই কামনা মোদের। আমেরিকা দীর্ঘজীবি হউক তার কাজে, সেটাই প্রমাণিত হউক।
বিশৃঙ্খলা কোন জাতির কাম্য নয়। আমেরিকা প্রমাণ করেছে কিভাবে বিশৃঙ্খলা দূর করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর অন্য দেশে এমন হলে, বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকতো। কত মারামারি হানাহানি হতো। আর আমেরিকা দেখিয়ে দিলো কিভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়। একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কিভাবে তাকে অচল করে দিতে হয়। নিরপেক্ষ প্রশাসন জো বাইডেনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবার জন্য কিনা করলো। অথচ তারা জো বাইডেনের কেউ নন। পরম মমতায় জো বাইডেনকে ক্ষমতার সিংহাসনে বসিয়ে সম্মানের সাথে স্যালুট দিয়ে যার যার কাজে ফিরে যায়।
বাইডেন জানলেনও না চিনলেনও না তারা কারা। এটাই আমেরিকার গণতন্ত্র, এটাই আমেরিকার সুন্দর্য। এদেশের জন্য চোখের জল না ফেলে কিভাবে পারি বলুন! বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে বলতে পারি, আমরা আমেরিকান। এ দেশ আমার অহংকার। এ দেশ প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপদ। আমেরিকা আমার গর্ব, আমেরিকা আমার ভালোবাসা। এ দেশের ক্ষতি হোক আমরা কেউ তা চাইনা।
Posted ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh