শনিবার, ৪ মে ২০২৪ | ২১ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

ঈদুল ফিতর : ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা ফারুক ফেরদৌস   |   শুক্রবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৪

ঈদুল ফিতর : ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ছবি: সংগৃহীত

মানুষের বৈচিত্র্যহীন কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে মাঝে মাঝে উৎসবের প্রয়োজন হয়। সামাজিক ও আত্মীয়তার শীতল হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো সজীব ও প্রাণবন্ত করতে প্রয়োজন হয় কোনও সম্মিলন বা মিলন মেলার। যেন মানুষ তার প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের হয়ে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারেন। নিরুদ্যম প্রাণে শক্তি ও কর্মপ্রেরণা জোগাতে পারে। সব আসমানি ধর্ম-সহ পৃথিবীজুড়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই বিভিন্ন উৎসব আছে। উৎসব জাতিগত ঐক্যের চেতনাও সৃষ্টি করে। উৎসবের দিনগুলোও যেকোনও জাতির স্বাতন্ত্র্র্য ও পৃথক পরিচয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও প্রতীক। একটি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয়-সত্তা নির্মাণ করতে, তাদের মধ্যে ঐক্যের চেতনা ও ভ্রাতৃত্বের মৈত্রী জাগ্রত করতে সম্মিলিত আনন্দ ও উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসুল (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলেন, তখন সেখানে জাহেলি যুগ থেকে প্রচলিত দু’টি উৎসবের দিন ছিল; শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘ মেহেরজান’।
রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই দিন কীসের? মদিনাবাসী সাহাবিরা বললেন, জাহেলি যুগ থেকে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা ও আনন্দ করি। রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ এই দুই দিনের বদলে তোমাদের নতুন দু’টি উৎসবের দিন দিয়েছেন: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (মুসনাদে আহমদ ১৩০৫৮)।
এভাবে মুসলমানদের পৃথক উৎসবের সূচনা হলো। এটা দ্বিতীয় হিজরি অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। রাসুল (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘সব জাতিরই ঈদ বা উৎসবের দিন থাকে, এটা আমাদের ঈদ।’ (সহিহ বুখারি ৩৯৩১, সহিহ মুসলিম ২০৯৮)।
‘ঈদ’ শব্দটি আরবি ‘আওদ’ থেকে উৎকলিত। ‘আওদ’ অর্থ ঘুরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। ঈদ মানে প্রতি বছর ঘুরে ফিরে আসে এ রকম একটি দিন। আরবিতে বিশেষ দিবস বা উৎসবের দিনকে ঈদ বলে। ফিতর অর্থ রোজা ভাঙা বা ইফতার করা। আমাদের কাছে পরিচিত ‘রোজার ঈদ’কে ইসলামি পরিভাষায় বলা হয় ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার উৎসব। পুরো রমজানে প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর মুসলমানরা উপবাস ভাঙে। এটা শুধু সেদিনের রোজা বা উপবাসের ইফতার। ঈদের দিন এক মাসের নিয়মিত উপবাস ভাঙা হয়। সেটাও এক রকম ইফতার। রোজাদারের জন্য প্রত্যেক দিনের ইফতারের মুহূর্তই আনন্দের, ঈদুল ফিতরের দিন বিশেষভাবে আনন্দের ও উৎসবের। রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দক্ষণ রয়েছে, ইফতারের সময় সে আনন্দিত হয়, রবের সঙ্গে দেখা করার সময় আবার সে আনন্দিত হবে। (বুখারি ৭৪৯২)।
ঈদুল ফিতরের দিন মুসলমানরা আনন্দিত হয় রমজানের রোজা সফলভাবে রাখতে পারা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তির কারণেও। এটা রোজাদার মুসলমানদের জন্য পুরস্কারের দিন। হজরত আউস আল আনসারী (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ফেরেশতারা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে মুসলমানগণ!
তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে এসো। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব-প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে এসো। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামাজ পড়েছো। তোমাদের দিনে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছো, এক মাস রোজা রেখেছো। গরিব দুঃখীদের আহার করানোর মাধ্যমে নিজের প্রতিপালককে তোমরা আহার করিয়েছো। এখন নামাজ পড়ে এসব পুণ্যকর্মের প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ করো। ঈদের নামাজ পড়ার পর একজন ফিরিশতা ঘোষণা দেন, শোন নামাজ আদায়কারীরা! তোমাদের মহান রাব্বুল আলামিন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আজ পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’ (আল মুজামুল কাবির লিত তাবারানি ৬১৭, ৬১৮)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঈদের দিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেন, তারা আমার ফরজ আদায় করে প্রার্থনার জন্য বের হয়েছে। আমার মর্যাদা বড়ত্ব ও সম্মানের কসম! আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনা কবুল করবো। তারপর আল্লাহ বান্দাদের উদ্দেশ করে বলেন, ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাদের পাপগুলোকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছি। এরপর সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। (বায়হাকির সূত্রে মেশকাত, অধ্যায়: হায়াতুল মুসলিমিন, পৃ: ২৪৯)।
ঈদুল ফিতরের একটি ওয়াজিব বা আবশ্যিক আমল হলো সালাতুল ঈদ বা ঈদের নামাজ। ঈদের উৎসব শুরু হয় এই সালাতের মাধ্যমে। ঈদের দিন প্রথম প্রহরে ধনী-দরিদ্র আমির-ফকির নির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে দাঁড়ায়। একসঙ্গে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহত্ব ঘোষণা করে। পরস্পরের খোঁজ-খবর নেয় ও কুশল বিনিময় করে। ইসলামে মুসলমানদের এই সম্মিলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সা.) নারী পুরুষ নির্বিশেষ সবাইকে ঈদগাহের জমায়েতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি কোনও নারী যদি ঋতুমতী হওয়ার কারণে নামাজ পড়তে না পারেন, তাকেও ঈদগাহে উপস্থিত হতে বলেছেন। উম্মে আতিয়্যা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবালিকা, পর্দানশীন ও ঋতুমতী নারীদের ঈদের সালাতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ঋতুমতী নারীরা সালাতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে তবে পুণ্যের কাজ (দান-সদকা) ও মুসলমানদের দোয়ায় অংশগ্রহণ করবে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুল্লাহ! আমাদের অনেকের ওড়না থাকে না। রাসুল (সা.) বললেন, তার কোনও বোন তাকে ওড়না দিয়ে সাহায্য করবে। (সহিহ বুখারি ১৯২৯)।
ঈদের আরেকটি আবশ্যিক আমল হলো সদকাতুল ফিতর। ক্ষমাপ্রাপ্তির খুশিতে এবং রমজানে কৃত আমলের ত্রুটি দূর করতে মুসলমানরা সদকাতুল ফিতর আদায় করে। সামর্থ্যবান ও সচ্ছল মুসলমানদের ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। ঈদ উদযাপন সার্বজনীন করে তুলতে, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতেই সদকাতুল ফিতরের বিধান এসেছে। পাশাপাশি এই সদকার মাধ্যমে রোজায় হয়ে যাওয়া ভুল-ত্রুটি মাফ হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম রোজাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথা-আচরণ থেকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে এবং দরিদ্রদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য সাদাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৬০৯)।
আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার সুযোগও হয় ঈদের সম্মিলন ও দাওয়াতে। ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ফরজ। সারা বছর কর্মব্যস্ততার কারণে আমরা অনেক আপনজনকেই ভুলে থাকি। সবার খোঁজ খবর সঠিকভাবে নেওয়া হয়ে ওঠে না। ঈদের উৎসবে সবাই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে অনেক কর্মজীবী মানুষ বাবা মায়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ ও সময় কাটানোর সুযোগ পায় ঈদের ছুটিতে।
ঈদের উৎসবে একটু আনন্দের মধ্যে থাকা, খেলাধুলা করা বা উপভোগ করার শিক্ষা আমরা নবীজির জীবন থেকে পাই। আয়েশা (রা.) বলেন, এক ঈদের দিন হজরত আবু বকর (রা.) আমার ঘরে এলেন। সেখানে তখন দু’জন মেয়ে বুআস যুদ্ধের গান গাইছিল। তারা গায়িকা ছিল না। হজরত আবু বকর (রা.) ওই মেয়ে দুটোকে শক্ত ধমক দিয়ে বললেন, শয়তানি বাদ্য! তাও রাসুলের ঘরে! রাসুল (সা.) বললেন, আবু বকর! ওদের ছেড়ে দাও। প্রতিটি জাতিরই ঈদ ও খুশির দিন থাকে। আজ আমাদের ঈদের দিন। (সহিহ বুখারি ৯৫২)।
আরেকটি রেওয়ায়াতে আয়েশা (রা.) বলেন, এক ঈদের দিন দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ ঢাল ও বর্শা দিয়ে খেলছিল। আমি রাসুলকে বললাম অথবা রাসুল (সা.) নিজেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বর্শার খেলা দেখতে চাও? আমি বললাম হ্যাঁ। রাসুল (সা.) আমাকে তার পেছনে দাঁড় করালেন। আমি রাসুল (সা.)-এর কাঁধে চেহারা রেখে খেলা দেখতে লাগলাম। রাসুল (সা.) বললেন, হুশিয়ার! হে বনি আরফাদা! (কোনও পক্ষকে উৎসাহ দিলেন বা সাবধান করলেন) (সহিহ বুখারি ৯৫০)।
সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর এই অবসরযাপন ও বিনোদন এক অনাবিল প্রশান্তি ও আনন্দ বয়ে আনে আমাদের জীবনে। আত্মীয়তা, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের বিভায় উজ্জ¦ল হয়ে ওঠে কয়েকটি দিন। আমাদের অবসাদ-ক্লিষ্ট জীবনের মরা গাঙে প্রাণশক্তির জোয়ার আসে। নতুন উদ্যম ও কর্মপ্রেরণা নিয়ে আমরা আবার কাজে ফিরতে পারি।
লেখক : ইসলামি লেখক, গবেষক।


advertisement

Posted ৪:৪৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৪

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6339 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1313 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1155 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.