আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ০৫ মে ২০২২
হাতের কাছেও কতকিছু দেখা হয় না। দেখার আকাংখা থাকলেও দেখতে না পেয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলতে হয়:
“নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
উঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?”
একটি সহজ শখ পূরণ করতে এক যুগ লেগে গেল। নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স থেকে ম্যানহাটানে যেতে যতবার কুইন্সবরো ব্রিজ অতিক্রম করেছি ব্রিজের সাইডওয়াক দিয়ে লোকজনকে হাঁটতে, জগিং করতে ও সাইকেল চালাতে দেখে ভেবেছি আমাকে পায়ে হেঁটে ব্রিজটি পার হতে হবে। কিন্তু হয়নি। ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় একা হয়ে ওঠে না। আমার স্ত্রী কামরুন নাহার মণির ঘোরাফেরার প্রচুর শখ। ওকেও বহুবার বলেছি, ‘চলো, একদিন হেঁটে ব্রিজটি পার হই।’ কিন্তু সে হাঁটতে রাজি হয় না। বলে, ‘আমারে কী ভূতে কিলাইছে!’ ঢাকায়ও সে হাঁটতে চাইতো না। বনানীতে থাকাকালে বাড়ির খোঁজখবর নিতে বা ভাড়া তুলতে প্রায়ই মিরপুর যেতে হতো। হাঁটতে আমার কোনোকালে ক্লান্তি ছিল না, এখনও নেই। কতবার পল্টন থেকে হেঁটে হেঁটে বনানী ফিরেছি। পথে বাদাম বা সিমের বিচি কিনে চিবুতে চিবুতে পথ অতিক্রম করতাম। বনানী থেকে মিরপুর ১১ নম্বর পর্যন্ত হেঁটে যেতাম। আমার স্ত্রী সঙ্গে যেতে চাইলে শর্ত দিতাম হাঁটতে হবে। কোনো কোনোদিন সে সম্মত হতো, তবে তার শর্ত ছিল পথে আখের রস খাওয়াতে হবে। রাস্তায় আঁখের রস পান করা নিয়ে আমার যথেষ্ট আপত্তি। নোংরা পানি দিয়ে আখ ধোয়, চারপাশে সারাক্ষণ ধুলিবালি ওড়ে, আখ মাড়াইয়ের যন্ত্রগুলো সাধারণত এমন জায়গায় স্থাপন করা হয়, যার পেছনেই বিলবোর্ডের আড়ালে পথচারিরা মূত্র ত্যাগ করে এবং সেই দুর্গন্ধযুক্ত তরল অনেক সময় স্তুপীকৃত আখের নিচ দিয়ে গড়ায়, রস উৎপাদনের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকটি নাক ঝাড়ে, ঘন ঘন বগলে হাত দেয়, অণ্ডকোষ চুলকায়। কিন্তু কার কথা কে শোনে। কেনাকাটায় বের হলে আখের রস করার যন্ত্র দেখলে সে অনিবার্যভাবে রস পান করবে। ওর যুক্তি হলো, ওর সাথে পানির বোতল থাকে, সেই পানিতে আখ ও গ্লাস ধুয়ে নেয়।
মিরপুর দশ নম্বর গোলচক্করে কেবল ফুট ওভারব্রিজটি চালু হয়েছে। কোনো প্রয়োজনেই আমাকে কখনও ওই ফুট ওভারব্রিজে ওঠতে হবে না। কিন্তু শখ বলে কথা। সেদিন স্ত্রী সাথে ছিল, বললাম, ‘চলো ব্রিজে ওঠি।’ কিছুতেই সে ওঠতে চায় না। ব্রিজে গোড়ায় আখ মাড়াই যন্ত্র ছিল, সেটি দেখিয়ে বলে, ‘আখের রস খাওয়ালে ওঠতে পারি।’ সে তার বোতলের পানিতে আখ-গ্লাস ও মেশিন ধুয়ে দুই গ্লাস আখের রস পান করে। আমাকেও পান করতে বলে, আমি পান করি না।
নিউইয়র্কেও আখের রস কিনতে পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট জায়গায় মোবাইল ভ্যানে আখ মাড়াই করে ৫০০ মিলিলিটার পরিমাণ গ্লাসে ৫ ডলার মূল্যে বিক্রি করা হয়। সামনেই আখ ছিলে, পরিস্কার পানিতে ধুয়ে মেশিনে পিষে রস পরিবেশন করা হয়। একদিন আমি স্ত্রীর জন্য কিনেও এনেছিলাম। নিউইয়র্কে আখের রস পেয়ে সে খুশি হয়েছিল। কুইন্সবরো ব্রিজে হাঁটার জন্য আমি ওকে আখের রস পর্যন্ত খাওয়াতে চেয়েছি। কিন্তু আমাকে সঙ্গ দানে রাজি করাতে পারিনি। পৃথিবীতে কে কাকে সঙ্গ দেয়? শুধু মনে হয়, আমরা সবার সঙ্গে আছি। আসলে আমরা প্রত্যেকে যার যার নিজের মধ্যে আছি। শাকিল বদাযুনীর লেখা মোহাম্মদ রফির গানের লাইন ভাবি:
“কোঈ না সাথ দেগা, সবকুচ ইয়েহি রাহেগা,
হ্যাঁ, জায়েঙ্গে হাম একেলে, ইয়ে জিন্দেগি কে মেলে,
দুনিয়া মে কম না হোঙ্গে, আফসোস হাম না হোঙ্গে।”
(কেউ তোমার সঙ্গী হবে না, সবকিছু এখানেই পড়ে থাকবে,
হ্যাঁ, জীবনের এই আনন্দ-উৎসব ছেড়ে আমরা একাই যাবো,
পৃথিবীতে কিছুই কমে যাবে না, আফসোস, তখন আমি থাকবো না)
অতএব কবিগুরুর “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে,” নীতিই ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণের জন্যবেদবাক্য হওয়া উচিত।
গত ২১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে আমাকে ম্যানহাটানের লেক্সিংটন এভিনিউয়ের ৬৩ স্ট্রিটে যেতে হয়েছিল। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। গিয়ে দেখলাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল হয়েছে। হাতে প্রচুর সময় পেলাম। রোজার দিন, খাওয়ার তাগিদ নেই। কুইন্সবরো ব্রিজ হেঁটে পার হওয়ার ইচ্ছা তাড়া দিতে শুরু করলো। হাঁটা শুরু করলাম। ব্রিজের সাইডওয়াকের অ্যাপ্রোচ পর্যন্ত পৌঁছতেই ৩০ মিনিট লেগে গেল। সকাল বেলায় খুব বেশি লোক হাঁটছে না। জগিং করছে আরও কম মানুষ। তবে প্রচুর বাইকারকে দেখলাম কুইন্স থেকে ম্যানহাটানের দিকে যাচ্ছে। কুইন্সবরো ব্রিজের বৈশিষ্ট হলো, দ্বিতল এই ব্রিজটি বিশ্বের দীর্ঘতম স্টিল ক্যান্টিলিভার বা দীর্ঘ খিলানযুক্ত ব্রিজ। ইস্ট রিভারের নর্থ ও সাউথ চ্যানেল এবং দুই চ্যানেলের মাঝখানে অবস্থিত মনোরম রুভেল্ট আইল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে গেছে গেছে এই ব্রিজ। অ্যাপ্রোচসহ মোট দৈর্ঘ্য ১.১৩ মাইল। প্রশস্ত ১০০ ফুট। উচ্চতা ৩৫০ ফুট। এই ব্রিজের ওপর দিয়ে দৈনিক দুই লাখের বেশি যানবাহন অতিক্রম করে। ব্রিজটির ইস্পাতের দীর্ঘ স্প্যান, সুউচ্চ কলাম, খিলান সাজাতে ইস্পাতের অংশগুলো নিপূণভাবে স্থাপনে প্রকৌশগত দক্ষতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। ব্রিজের নির্মাণকাল ১৯০০ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত। যখন ভারি বস্তু উত্তোলনের ক্রেন ছিল না, কীভাবে এই বিশাল ওজনের ইস্পাতের বিম, কলাম ওঠানো হলো, সোজা করে বসিয়ে বা খাড়া করে এমনভাবে নাটবল্টু লাগানো হলো যে শতবছর পার হয়ে গেলেও নিয়মিত মেরামত ও সংরক্ষণ করলে এর কোনো ক্ষতি হবে না Ñ ভাবলে ভিড়মি খাওয়ার অবস্থা হয়।
অ্যাপ্রোচ থেকে ব্রিজ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। ধীরে ধীরে হাঁটি। বয়স। ৩৫ বছর আগেও ঢাকায় সচিবালয়ে লিফটের সামনে ভিড় দেখলে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ৭/৮ তলায় ওঠে যেতাম, ক্লান্তি অনুভব করতাম না। ইসলামাবাদের মারাগালা হিলসের শীর্ষে গাড়িতে না ওঠে রাস্তার উল্টো দিক থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠেছি। ২০১০ সালেও অরিগনের মাল্টনোমাহ ফলসের উৎস দেখতে আঁকাবাঁকা পথে নির্ধারিত এক মাইল উচ্চতায় আরোহণ করেছি। হে ইশ্বর, এখন এই ব্রিজের সামান্য ৩৫০ ফুট উচ্চতায় ওঠতে আমাকে হাঁপাতে হয়! ব্রিজের কেন্দ্রস্থলে পৌছে আমি ইস্ট রিভার, রুজভেল্ট আইল্যাণ্ড ও ম্যানহাটানের সৌন্দর্য দেখতে কিছুক্ষণ দাঁড়াই।
ব্রিজের নীচে যে রুজভেল্ট আইল্যান্ড, গত বছর সামারের মাসগুলোতে সেখানে আসতে হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা করনেল ইউনিভার্সিটির একটি ক্যাম্পাস আছে এই আইল্যান্ডে। ক্যাম্পাসে যেতে আসতে কুইন্সবরো ব্রিজের বিশালাকার একটি স্তম্ভ অতিক্রম করতাম এবং আমার ব্রিজে ওঠার ইচ্ছা আরও প্রবল হতো। ব্রিজ বরাবর ট্রামওয়ের ল্যান্ডিং স্টেশন ক্যাম্পাসের পাশেই। নদীপথে মাঝে মাঝে শব্দ করে অতিক্রম করছে স্পিডবোট, ওয়াটার বাইক। এছাড়া নিউইয়র্ক সিটি ফেরি সার্ভিসের নৌযান, নদীর সৌন্দর্য দেখতে উৎসুক দর্শনার্থীদের নিয়ে ক্রুজ সার্ভিও ও মালবাহী বার্জ চলাচল করছে সারাক্ষণ। স্বাস্থ্য সচেতন নারী-পুরুষ নদী তীর বরাবর ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে রুজভেল্ট আইল্যান্ড নিউইয়র্কবাসীর দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম। ব্রিজের ওপর থেকে ভিন্নভাবে দৃশ্যগুলো দেখছি।
রুজভেল্ট আইল্যান্ড খুব বড় দ্বীপ নয়। দৈঘ্যে প্রায় দুই মাইল হলেও কোনো কোনো পয়েন্টে প্রস্থ সর্বোচ্চ আটশ’ ফুট। মোট আয়তন ১৪৭ একর। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বীপটির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টের সম্মানে ১৯৭৩ সালে দ্বীপের নামকরণ করা হয় ‘রুজভেল্ট আইল্যান্ড’। উনিশ শতক জুড়ে দ্বীপে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও একটি কারাগার ছিল। ১৮২৮ সালে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ দ্বীপটি কিনে নেয় এবং কারাগারের বন্দীদের জন্য একটি হাসপাতাল ও একটি মানসিক রোগীদের আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে। ১৮৫২ সালে সেখানে ছোটখাট অপরাধীদের আটকে রাখার জন্য আরেকটি কারাগার ও বসন্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আরেকটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। বিংশ শতাব্দী ছিল দ্বীপের পরিবর্তনের সময়। কুইন্সবরো ব্রিজ চালু হওয়ার সময়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন চলে আসে। এখন রুজভেল্ট আইল্যান্ড পুরোটাই দৃষ্টিনন্দন এক দ্বীপ। আইল্যান্ডের অভ্যন্তরে যাতায়াত করার জন্য রয়েছে বিনাটিকেটের রেড বাস সার্ভিস। ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য রুজভেল্ট আইল্যান্ডের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি পার্ক রয়েছে। উত্তর প্রান্তে লাইটহাউজ পার্ক বেশ পুরনো। দক্ষিণ প্রান্তে ফ্রাংলিন ডি রুজভেল্ট ফোর ফ্রিডম পার্ক চালু হয়েছে ২০১২ সালে। কিন্তু রুজভেল্ট আইল্যান্ড পুরোটাই একটি বিশাল পার্ক।
Posted ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ মে ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh