ডা. ওয়াজেদ এ খান | বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১
ঘাতক ব্যাধি করোনা কেড়ে নিয়েছে ডাঃ হুমায়ুন কবির মুকুলের প্রাণ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এম-১৪ ব্যাচের ছাত্র মুকুল। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন অর্থোপেডিক সার্জারীত। অবসর জীবনেও শেষদিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন মানুষের সেবায়। মেডিকেল কলেজে ডাঃ হুমায়ুন কবির মুকুল ছিলেন আমার সহপাঠি। সদা হাস্যোজ্জল, অমায়িক স্বভাবের বন্ধু বৎসল মুকুলের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে। ভাবিয়ে তুলেছে নিশ্চিত এই পরিণতি সম্পর্কে। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। সমব্যথিত তার পরিবারের সাথে।
মহান আল্লাহ তায়ালার অমোঘ বিধান মৃত্যু। এর হাত থেকে রেহাই নেই কারো। দু’দিন আগে অথবা পরে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে সবাইকে। মৃত্যুর কোন কাল নেই। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির বিষয়টি উচ্চারিত হয় কখনো কখনো। আমরা সহজভাবে নিতে পারিনা মৃত্যুসংবাদ। যেমনটি পারছিনা বন্ধু মুকুলের মৃত্যুতে। মুকুলকে চিনি প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে। বলা যায় প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে তার সাথে পরিচয়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এম-১৪ ব্যাচের প্রথম ক্লাশে ঘটে পরিচয় পর্ব। উনিশ’শ ছিয়াত্তুরের ৮ নভেম্বর, দিনটি ছিলো সোমবার।
কলেজের দু’নম্বর গ্যালারীতে দু’শত ছাত্রছাত্রীর অভিষেক। আনন্দঘন সেই ক্ষণ, সেইদিনের স্মৃতি আজো অম্লান। মেডিকেল শিক্ষা জীবনের মাইল ফলক। এরপর দিন যতো গড়ায় পরিচিতি বাড়তে থাকে দ্রুত। বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত হতে থাকে মজবুত। আমাদের ক্লাশে তিন ব্যাচে ১৬০জন ছাত্র ও ছাত্রী ছিলো ৪০জন। এদের মাঝে আমার ঢাকা কলেজের বন্ধু ছিলো জনা তিরিশেক। বাকীরাও বন্ধু হয়ে যায়। জানা হয়ে যায় সবার নাম ঠিকানা। সহপাঠীদের প্রায় সবার বাড়ি কোন জেলায়, কোন থানায় এমনকি অনেকের গ্রাম মহল্লার নামও ছিলো আমার চেক লিস্টে। আমাদের ভেতর রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা ছিলো। কিন্তু কোন বিভেদ, বিদ্বেষ ছিলো না পারস্পরিক সম্পর্কে। সময়ের ব্যবধানে জীবন জীবিকার অন্বেষণে বন্ধুদের অনেকেরই বসবাস এখন বিশ্বজুড়ে। আমি নিজেও ছিয়াশির মাঝামাঝি থেকে বাস করছি বিদেশে। প্রায় সাড়ে তিন দশক হলো। তারপরও অনেক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হয়, দেখা হয় দেশে বেড়াতে গেলে। দীর্ঘ এ সময়ের কারণে অনেকের চেহারা এখন অপসৃয়মান। সাময়িক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে আবার ফিরে পাচ্ছি ঘনিষ্ঠ অনেককে। যেমনভাবে পেয়েছি বন্ধু মুকুলকে। যতোটুকু মনে পড়ে ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো ‘৯৪ সালে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পুর্ণমিলনীতে। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি।
চলতি বছর ৬ জানুয়ারি রাত প্রায় ১১টায় ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে একটি ভিডিও কল আসে নিউইয়র্কে। রিসিভ করে দেখি অপরপ্রান্ত থেকে কথা বলছে মুকুল। চেহারা ও স্বাস্থ্যে পরিবর্তন এলেও হাসিমাখা মুখটা ছিলো আগের মতোই উজ্জ্বল। দীর্ঘক্ষণ কথা হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে। স্মৃতি তর্পন চললো অনেক সময় ধরে। এরপর বার তিনেক কথা হয়েছে ফোনে। শেষ কথা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। মার্চের মাঝামাঝি স্বস্ত্রীক দেশে যাওয়ার কথা জানালাম তাকে। মুকুল আমন্ত্রণ জানালো ময়মনসিংহে তার বাসায় যাওয়ার। সম্মত হয়েছিলাম ময়মনসিংহ গেলে তার বাসায় আতিথ্য গ্রহণে। প্রতিবছর যখন দেশে যাই তখন কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও ময়মনসিংহ যেতে হয়। সন্তানদেরকে নিয়ে বার কয়েক গিয়েছি মেডিকেল কলেজ চত্বরে।
ময়মনসিংহ একসময় ছিলো খুবই প্রিয় শহর। জীবনের সুবর্ণ একটি অধ্যায় কেটেছে সেখানে। তখন প্রতিটি দিন ছিলো সোনালী রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত। জীবনের শেষ দিনগুলো ময়মনসিংহে কাটাবো এমন বাসনা থেকে বৈষয়িক কিছু প্রস্তুতিও নেই আশির দশকে। মুকুলকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। এবার মুকুলকে নিয়েই সেখানটায় যাওয়ার কথা ছিলো। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে গিয়েছিলাম। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো ২২মার্চ সকালে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাবো। মুকুলকে আগের রাতে ফোন করে পেলাম না। পরদিন ময়মনসিংহে পৌছে বার কয়েক ফোন করলাম।
কিন্তু প্রতিবারই বন্ধ পেলাম ফোন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাজ সেরে বিকেলে ঢাকা ফিরছিলাম। ত্রিশালের কাছাকাছি এসে ফোনটা হাতে নিতেই ফেসবুকে দেখলাম মুকুল করোনাক্রান্ত। সিএমএইচের আইসিওতে ভর্তি। ইচ্ছে থাকলেও দেখার কোন সুযোগ ছিলো না। এরমধ্যে নিউইয়র্ক ফিরে আসি। ক’দিন পর জানতে পারলাম মুকুল অনেকটা ভালো। কিন্তু সব প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হয় ২৪ এপ্রিল। বন্ধু মুকুল আমাদেরকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। মুকুলের মৃত্যু সংবাদটি আমাকে বড় বেশি পীড়িত করেছে। তার সাথে শেষ দেখা হলোনা বলে। মুকুল যেদিন মারা যায় সেদিনই নিউইয়র্কে সহপাঠী দু’বন্ধু ডাঃ শ্যামল ও ডাঃ বুলুর সাথে মুকুলের অসুস্থতা নিয়ে আলাপ করি। ছাত্র জীবনে একবার মুকুলের কেওয়াটখালীর বাসায় গিয়েছিলাম আমি ও বর্তমানে আমেরিকার মিশিগানে বসবাসরত ডাঃ সেলিম। আমাদের ক্লাশে চারজন হুমায়ুন ছিলো। হুমায়ুন কবির মুকুলের বাড়ি ছিলো ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালীতে। ছোট হুমায়ুন কবিরের বাড়ী ছিলো চাঁদপুর জেলার মতলবের আশ্বিনপুর গ্রামে। শাখাওয়াত হোসেন খান হুমায়ুনের বাড়ি নেত্রকোনা সদরে। আর মুসলেহ উদ্দিন হুমায়ুনের বাসা ছিলো ঢাকায় মোহাম্মদপুরে। তার পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালী। এই হুমায়ুনও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে পরপারে।
এম-১৪ ব্যাচের সহপাঠীদের মধ্যে ১৯৯৭ সালে প্রথম মারা গেছে ডাঃ আসাদুজ্জামান। আসাদ ছিলো আমার ঢাকা কলেজের বন্ধু। সর্বশেষ মারা গেলো ডাঃ হুমায়ুন কবির মুকুল। এর মাঝে আরো কয়েকজন বন্ধুকে হারিয়েছি আমর। এভাবে কাউকেই হারাতে চাইনা। তা যে যেখানে, যেভাবে যতো দূরেই থাকিনা কেন। এম-১৪ ব্যাচ একটি সুবিশাল পরিবার। এ পরিবারের যেসকল সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। তারা পরপারে ভালো থেকো। জান্নাতবাসী হও। মহান আল্লাহ সুবহানা তায়ালার নিকট রইলো আমাদের হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা। আমিন।
নিউইয়র্ক, ২৬ এপ্রিল, ২০২১।
Posted ১১:১১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh