আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২
উন্নত জীবনের আশায় হোক, জীবিকার তাগিদে হোক, অথবা অন্য কোনো কারণে হোক, বাংলাদেশ থেকে যারা আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে আসেন, তারা রুজিরুটির জন্য যা করেন, তা আর যাই হোক “চাকুরি” নয়, “কাজ”। তারা কখনও অফিসে যান না, তারা “কাজে” যান। কারও বাড়িতে ফোন করলে জানা যায়, “ভাই বা আপা কাজে,” অথবা “ভাই বা আপা’র কাজ থেকে আসতে দেরি হবে।” বাংলাদেশে যারা নয়টা-পাঁচটা অফিস করতেন, তারা পাশ্চাত্যের দেশে এসে তাদের নিয়োগ কর্তার স্থির করা শিফট অনুযায়ী কাজ করেন। মর্জি হলে মালিক ঘন্টা বাড়িয়ে দেন, মর্জি হলে কমিয়ে দেন। তারা প্রতিবাদ করেন না, “কাজ” যেহেতু মালিকের মর্জির অধীন, কারও কাজে বা আচরণে সন্তুষ্ট না হলে বলে দিতে পারেন, “এই নিন আপনার পাওনা, কাল থেকে আসবেন না।” যারা বাংলাদেশে যেমন-তেমন কাজকে ছোটলোকের কাজ মনে করতেন, তাদের মুখে অমিয় বাণী শোনা যায় “কাজ তো কাজই, এর আবার ছোটবড় কি?” আসলে “কাজ মানে অর্থ।” দেশে যারা কোনো “কাজ” করতে একশ’ বার ভাবতেন “পাছে লোকে কিছু বলে,” অর্থের পরিমাণ লোভনীয় হলে তারা বলেন “সব কাজই সম্মানের।”
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি হাসিলকারী অথবা মর্যাদাবান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, এমন অনেকে উন্নত দেশে ট্যাক্সি চালান, কিন্তু বলেন “কাজ করি।” খুব কম সংখ্যক আছেন, যারা বলেন, “ট্যাক্সি চালাই।” হোটেল ও বারগুলোতে উচ্চবেতনে কিছু ছোটখাট কাজ আছে, যেমন; হোটেলের রুম সার্ভিস এবং বারে পানীয় পরিবেশন। এই চাকুরির কথা বলেন না, কমিউনিটিতে ছোট হয়ে যেতে পারেন বলে, তারা বলেন, “ইউনিয়ন জব” করি, ছয় ডিজিটের বেতন পাই। ইউনিয়ন জব হচ্ছে, তারা অনুমোদিত শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত, চাইলেই হুট করে তাদের চাকুরিচ্যুত করতে পারবে না। তাদের চাকুরি প্রটেকটেড, তবু তারা চাকুরি নয়, “কাজ” করেন। এবং মজার ব্যাপার হলো, তাদের অনেকে ছুটির দিনে বা অবসর সময়ে বিনা বেতনে অথবা নামমাত্র বেতনে এমন কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হন, যে পরিচয়কে কমিউনিটিতে বুক ফুলিয়ে চলার মতো মর্যাদাবান মনে করা হতে পারে।
বাংলাদেশে “সিভিল সার্ভিস” মানে বিরাট ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তা নয়, এখানে প্রতিটি পর্যায়ের সরকারের নিজস্ব “সিভিল সার্ভিস” রয়েছে, যার আওতায় সিটির বিভিন্ন এজেন্সির তুচ্ছতম কাজ, তা জেনিটারের কাজ হোক বা ডিটেনশন সেন্টার বা কারাপ্রহরীর কাজ হোক, সবই সিভিল সার্ভিসের অর্ন্তভূক্ত। যেমন, নিউইয়র্ক সিটির “ডিপার্টমেন্ট অফ সিটিওয়াইড অ্যাডমিনিস্ট্রেভ সার্ভিসেস,” নিউইয়র্ক সিটি সরকারের সকল স্তরের কর্মচারিদের নিয়োগ করে। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান “পাবলিক সার্ভিস কমিশন। নিয়োগের যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। নিয়োগপ্রাপ্ত হলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং চাকুরিগুলোকে “সরকারি চাকুরি” বলা হলেও সিভিল সার্ভেন্টরা সরকারের চাকুরি করেন না, তারা রাষ্ট্রের চাকুরি করেন। একজন সিভিল সার্ভেন্টকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করতে হলেও তা করতে পারেন কেবল রাষ্ট্রপতি। কেবল সিভিল সার্ভেন্ট নয়, রাষ্ট্রের কর্মচারি পিয়নকেও যদি চাকুরি থেকে বাদ দিতে হয়, তাহলে অনুরূপ পত্রে স্বাক্ষর করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে।
আসলে “চাকুরি” ও “কাজ” এর মধ্যে পার্থক্য কী? ব্যবহারিক ইংরেজি বিষয়ক দু’জন গবেষক গ্যাব্রিয়েল মিলার ও গ্যাব্রিয়েল ক্লার্ক এর মধ্যে চাকুরি হচ্ছে জীবনযাপনের প্রয়োজনে অর্থ উপার্জনের জন্য কোনো কর্মকাণ্ডের যুক্ত হওয়ার নাম “চাকুরি,” আর অর্থ উপার্জনের জন্য যেকোনো কাজে শারীরিক ও মানসিক শ্রম নিয়োগ হচ্ছে “কাজ”। “চাকুরি” হচ্ছে, বিশেষ্য; “কাজ” ব্যবহৃত হয় বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ হিসেবে। যেমন: চাকুরির ক্ষেত্রে, “আহমেদ বড় এক কোম্পানিতে “চাকুরি” পেয়েছে,” কাজের ক্ষেত্রে “আহমেদ গ্যাস স্টেশনে কঠোর পরিশ্রমের “কাজ” করে।” ব্যাকরণগতভাবে “চাকুরি” এবং “কাজ” সমার্থক নয়, কিন্তু কেউ চাইলে শব্দ দুটিকে অদলবদল করে ব্যবহার করার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। তবে “চাকুরি’ কোনো পেশার সমার্থক, যেমন: ব্যাংকার, ক্লিনার, শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি; কিন্তু “কাজ” যেকোনো তৎপরতা, তা শারীরিক ও মানসিক হতে পারে। সব ধরনের চাকুরিকে “কাজ” বলা যেতে পারে, কিন্তু সব “কাজকে” “চাকুরি” হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না বলে উপরোক্ত দুই গবেষকের বক্তব্য। তবে তারা স্বীকার করেন যে “চাকুরি’তে সম্পন্ন কাজ হিসাবযোগ্য, কিন্তু যারা “কাজ” করেন সাধারণত তা অগনন।
Posted ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh