শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

নিউইয়র্কে ছেলের বাবা মায়েরা বড় নিরুপায়

মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ   |   বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

নিউইয়র্কে ছেলের বাবা মায়েরা বড় নিরুপায়

আমার সহকর্মী মোহাম্মদ হোসেন একজন বয়স্ক মানুষ। আমেরিকা এসেছেন বহু দিন হয়। কাজ করেছেন বহু জায়গায়। তার বাবা পূর্ব পাকিস্তান আমলে রেলওয়ের মেম্বার ছিলেন। তার চাচাও ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদার মেম্বার ফাইনান্স। মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রীও ছিলেন ইডেন কলেজের ফিজিক্স এর অধ্যাপক, মোহাম্মদ হোসেন ছেলে মেয়ে পরিবার সহ নিউইয়র্কে থাকেন। তার ভাই বোনেরাও সবাই আমেরকিায়। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তার এক ভাই ডাক্তার, থাকেন নিউজার্সিতে। মোহাম্মদ হোসেন কাজে এসে প্রায় সময়ই ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ নাড়া দিয়ে বলেন, আরে ভাই কাজে এসে ঘুমান কেন চাকরীটা তো খাবেন। চোখ মেলে রেগে জান কোথায় দেখেন আমি ঘুমাই। আমি এ ভাবেই থাকি ঘুমাই না। স্বীকার করেন না যে তিনি ঘুমান। এ ভাবে বহু দিন কেটে যায়। একদিন ঠিকই জমদূত এলো, ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তার চাকুরীটা চলে গেল।

সেই যে চলে গেলেন আর দেখা নেই। পরে শুনলাম অনেক দিন ঘুরাঘুরির পর এক জায়গায় চাকুরী হলো। একদিন হোসেনকে বললাম, এই বয়সে এসে কেন চাকুরী করেন। ছেলে পেলেরা ভালো চাকুরী করে আপনার অভাব কি? উত্তরে হোসেন বলেন, আপনার প্রশ্নটা সঠিক নয়। অবসর জীবন ভালো না। আপনি ছেলে মেয়ে স্ত্রীর কাছেও উচ্ছিষ্ঠ হবেন। তারা আপনাকে ভালো চোখে দেখবে না তখন। এ জন্যেই চাকুরী করি।


চাকুরী করি বলেই এখনো বেঁচে আছি সুস্থ আছি। চাকুরী না করলে এত দিনে বাঁচতাম না। নিজের টাকায় নিজে চলি। নিজের শক্তি নিজে খুঁজি। প্রায় বন্ধের দিনই সবাইকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাই। জানান দেই আমি আত্মনির্ভরশীল, আমি বেকার নই। আমি এখনো নিজেরটা দিয়ে নিজে চলি। কারো কাছে হাতপাতি না। নিজের শক্তিই বড় শক্তি। আমি আমারটা খাই। নিজের শক্তিতে নিজে চলি। এটিই আমার বাহাদুরি।

আপনার নাই ছেলে সন্তানও দূরে চলে যায়। স্ত্রীও চিনে না তখন। সবার কাছে হাতপাততে হয়। আপনি ক্ষণিকেই সবার কাছে পর হয়ে গেলেন। কথাটা নির্মম সত্য। তার কথা শুনে ভয়ে আতকে উঠলাম। আমার কপালে না জানি কি আছে এ জীবনে। কি বাস্তব কথাটানা বলে গেলেন মোহাম্মদ হোসেন। যাবার কালে সে আমাকে চোখ কান খুলে দিয়ে গেছেন।


তার কথাটি প্রায়ই আমি ভাবি। কি হতো আমার জীবনে যদি চাকুরীটা না থাকতো। আমি টিকে আছি আমার আছে বলে। তা না হলে কোথায় থাকতাম আমি এত দিনে। কে আমায় দেখতো আপন করে। আমার আমিকে চিনি বলেই আমি এখনো বেঁচে আছি। তা না হলে আমার জীবন শূন্য হয়ে যেত। নিজের হাহাকার সন্তানেরাও বুঝতো না তখন। আপনার নাই, পৃথিবীতে আপনি একা হয়ে গেলেন। আপনার অভাব অভিযোগ বুঝে না কেউ। আপনি কি চান জানতে চায় না কেউ। আপনার সাথে কথা বলে না কেউ। আপনি প্রয়োজনহীন। কারো সময় নেই আপনার সাথে কথা বলার। আপনি এত বড় পৃথিবীটাতে বড় একা। কেউ নেই আপনার। এক সময় আপনার ডাকে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠতো, এখন আপনার ডাকে আসে না কেউ। আপনি কতটা নিষ্প্রয়োজন এ পৃথিবীতে।

অভাবের সংসারে যে বাবা সন্তানের-মুখে খাবার তুলে দিতে কত কিইনা করেছেন। বৃদ্ধ বয়সে এসে সেই বাবা অসহায় হয়ে পড়ে আছেন। তাকে দেখার কেউ নেই। শূন্য হয়ে গেছে পৃথিবী তার কাছে। পৃথিবীও আপনাকে চায় না তখন। নি:স্ব এ পৃথিবীতে আপনার কেউ নেই কিছুই নেই। আপনি যেখানে যাবেন সাগরও যেন শুখিয়ে যায় তখন। সন্তানদের জন্য বাবা কত-না কষ্ট করেছেন। যে বাবা তার জীবন বাজি রেখে রাত দিন পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন, আনন্দ খুঁজেন সন্তানের হাসি দেখে। বৃদ্ধ বয়সে সেই সন্তানেরা বৃদ্ধ মানুষটিকে পর করে দেয় নিমিশেই। খোঁজ নেয় না বাবার। ভাবে এ বৃদ্ধ মরে না কেন এখনো। বৃদ্ধ মানুষটি হয়ে পড়ে সংসারের জঞ্জাল। দেখতে পারে না কেউ। সন্তানেরা বাবা-মায়ের মুখ দেখতেও চায় না তখন।


নিজের বাড়ীতে বৃদ্ধ মানুষটি হয়ে যায় পরবাসী। নিজের বাড়ী থেকে চলে যেতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানেই হয়ে যায় তার স্থায়ী ঠিকানা। একটুও ভাবে না এ জীবন তারও কপালে আসতে পারে এর চেয়েও ভয়াবহ হয়ে। প্রকৃতি কিন্তু ছাড়ে না কাউকে। বিচার করে নেয় কড়ায় গন্ডায়। বাবা-মায়ের সাথে যা করেছিলে তোমার বৃদ্ধ বয়সে এর চেয়েও কঠিন কষ্ট তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিয়তি ছাড়ে না কাউকে। আজকাল প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এমন দৃশ্য দেখা যায়। নিউইয়র্কের রাস্তা ঘাটে এমন চিত্র প্রায়শই চোখে পড়ে। বড়ই কষ্টকর। যা ভুলবার নয়।

এখানে দুই কিছিমের মানুষ বাস করে। স্বামীর বাবা-মা আর স্ত্রী পক্ষের বাবা-মা। মেয়ের বাড়ীতে এসে তারা আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। হাসিতে খুশীতে পানের চিপটি জামা কাপড়ে ভরায়। সুখের হাসি ধরে না তাদের। আড়াম আয়েশে দিন কাটায়। শ্বশুর শাশুড়ী বউ মিলে জামাইকে দিয়ে থালাবাসন ধোয়ায়, ঘর-মোছায়, কাপড়চোপড় ধোয়ায়। বউ এর দল ভারি বউও চাকুরী করে সেও কম নয়। তার ক্ষমতাই বেশী। স্বামী বেচারা হয়ে পড়ে অসহায়। আমার পরিচিত এক পরিবার। শ্বশুর শাশুড়ি শালার উৎপাতে লোকটা অসহ্য হয়ে পড়ে। প্রতিদিন বারো ঘন্টা কাজ শেষে বাড়ীতে এসে ঘরের ধোয়া মোছা সব কাজ শেষে শোয়ারও জায়গা নাই।

অন্যরা আনন্দ উৎসবে ব্যতিব্যস্ত। উপায় অন্তর না দেখে নিজের কষ্টের বাড়ী ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি কেউ। নিউইয়র্কে যে কোন বয়স্ক লোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, আপনাকে কে এনেছে, উত্তরে বলবেন মেয়ে এনেছে। কালেভদ্রে কাউকে পাবেন বাবা-মাকে ছেলে এনেছে। বউ এর পারমিশন ছাড়া স্বামী বেচারার উপায় নেই বাবা-মাকে আনার। যদিও কোন ছেলে তার বাবা-মাকে এনেছেন, তাদের দুর্গতির শেষ নেই। চোখের জল আর পানি এক সাথে করে চলেছেন। বউ এর জ্বালায় একটু শোয়ারও জায়গা নেই। বুড়ো বুড়ি কোথায় যায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সময় কাটায়। বাবা না হয় মসজিদে নামাজ পড়ে সময় কাটান, মা যান কোথায়। মার উপায় কি। ছেলের মা’দের কষ্টের আর সীমা নেই।

ছেলের বউ এর অত্যাচারে দু’চার মাস পর দেশে ফিরে যান। পারলো না নিজের ছেলেকে বুকে রাখতে। অহরহ দেখা যাচ্ছে এসব চিত্র। ভালো যে কিছু নেই তা নয়, তবে খারাপের চিত্রই বেশী এ প্রবাসে। এ নিয়ে মটিভেশনের দরকার আছে। চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে এসব বাবা মাদের নিয়ে । বউরা স্বামীর বাবা-মাকে সহ্যই করতে পারে না নিজের ঘরে। দিনকে দিন এদের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনি কিছু বলতেও তো পারবেন না তাদের। পুরুষের সাথে সমানতালে কাজ করে চলেছে নারীরা এখানে। তাদের হাতে প্রচুর ডলার। সে মানে না স্বামীকে। সে স্বামীর চাইতে কম কিসে। আপনি কিছু বলবেন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। বলবে, আপনি তাকে টর্চার করছেন। তার নিরাপত্তা বিগ্নিত হচ্ছে আপনার দ্বারা। তখন নিউইয়র্কে থাকাটাই দুস্কর হয়ে যাবে আপনার। আপনার কিছুই করার নেই। আপস করে চলতে হবে। মন চায় বাবা-মায়ের জন্য করতে, পারে না বউ এর কারণে। বউকে না জানিয়ে দেশে বাবা-মা’র জন্য টাকা পাঠায়। জানলে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হয়। নিজের টাকা নিজের কথা বলে না। অশান্তি করার চাইতে স্বামী চুপ করে থাকে। এভাবেই চলতে হয় প্রবাসে। কষ্টের সীমা নেই ছেলের বাবা মার। ছেলের বউ বলে, যেমনি এসেছে আসার ঝালটা মিটিয়ে দেই। দিন রাত কাজ করান শ্বশুর শ্বাশুরীকে দিয়ে। বাসার কাজ, নাতি নাতনি লালন পালন। স্কুলে আনা-নেয়া থেকে সব কাজ করেও ছেলের বউএর মুখে হাসি আনতে পারেন না একটুও। পান থেকে চুন খসলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন।

মনে হয় যেন এখনই বের করে দিবেন। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর চোখের জল মুছার কেউ নেই। বউ একটুও বুঝতে চায় না এরা আছে বলেই সে কাজ করতে পারছেন। তারা আছেন বলেই বাচ্চাদের টেইককেয়ার হচ্ছে। সে হাজার হাজার ডলার কামাই করতে পারছে শশুর শাশুড়ি আছে বলেই। বউ এর একটুও কৃতজ্ঞতা নেই তার চোখে মুখে ব্যবহারে। কেমন দিন এসে গেছে এ দুনিয়াতে। আগের কালে দেখেছি ছেলের বউয়েরা শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সেবা যত্ন করে আনন্দ খুঁজে পেত। ছিল তাদের সংসারে অনাবিল সুখ শান্তি। আজকালকার দিনে সে সব কিছু নেই্, সামান্য সম্মানটুকুও ওঠে গেছে মন থেকে। বউদের নিয়ে অশান্তি বেড়ে গেছে প্রবাসে। এরা এখন স্বামীর কন্ট্রোলে নেই। সে স্বাধীন যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়।

একটুও ভাবে না এটিও যে কত বড় মানবতা। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে পাঠিয়েছেন এ জন্য। আপনাকেও আসতে হবে এমন দিনে। তখন কিন্ত ঠিকই বিচার পেয়ে যাবেন হাতে নাতে। আপনার অবস্থা কিন্ত এর চাইতেও কঠিন হতে পারে। সেই দিনটি হয়তো অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। কঠিন শাস্তি পেতে হবে আপনাকে। পার পাবেন না কোন মতে। আল্লাহর কঠিন বিচার পেয়ে যাবেন নিমিষেই। একটু অপেক্ষা করতে হবে শুধু। চোখের পানি মুছেও কুল পাবেন না কিন্ত। তখনই মনে পড়বে কি করে চলেছেন, কি করা উচিত ছিল। হিসেব কিন্ত একই।

কোন এক সময় এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলছিলাম। চুল দাড়ি দপদপে সাদা। দেখতেও কি সুন্দর চেহারা। বললাম কি করেন, উত্তরে বলেন মাংসের দোকানে মাংস কাটি। এখানে কে থাকে। ছেলে তার বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে। আমি মেসে থাকি। কেন, ছেলের কাছে থাকেন না। থাকতে পারলে কি মেছে থাকি। এত বড় ঘরটাতে একজন্ মানুষের জন্য এক কোনায় জায়গা নেই।

খাবার খান কোথায়। নিজে রান্না করে খাই। কেন ছেলে খাবার নিয়ে আসে না। আনলে তো সবাই দেখতো। আমি তো ছেলের বাসা থেকে দুই ব্লক দূরে থাকি। কেন, আপনাকে দেখতে আসে না। এক বছর হয়ে গেল দেখলাম না তো আসতে। বলেন কি ছেলেটা কি করে। নিউইয়র্কের এক ডাক্তারের পত্রিকা অফিসে চাকুরী করে। ভালোই বেতন পায়, নইলে কিভাবে বাসা চালায়। আপনার বউ অন্য ছেলে মেয়েরা কই! তারা দেশে, আসতে চায় না কেউ। আসলে থাকবে কই! আমিই দেশে যাই, গিয়ে তিন চার মাস থেকে আসি। এই হলো আজকের প্রজন্মদের অবস্থা। সন্তানের মন চায় না বাবা মাকে দেখার। খবর রাখে না বাবা-মার। ঐ বাবার কষ্টের নি:শ্বাসে নিশ্চই আল্লাহর আরশ কেপে ওঠে। দিন শেষে তারও হয় তো আসতে হবে এমন দিনে। আল্লাহর কঠিন বিচার পেয়ে যাবে এ দুনিয়াতে। থাকবে না সন্তান বউ পাশে। ইতিহাসের কু-সন্তান হিসেবে সমাজ ঘৃণায় থুতু থুতু ফেলবে তার মুখে।
ফোন : ৬৩১-৪৮০-৫৭৬৮, [email protected]

advertisement

Posted ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6134 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1300 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1144 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.