ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২১
(শেষ পর্ব) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ তথা মিত্র শক্তির পক্ষে অবস্থান নিলে জাপানকে সমর্থন দানকারী বর্মিরা নিশ্চিন্ত হয়ে যায় যে এদের বার্মা থেকে যে করেই হোক বিতারণ করতেই হবে। আং সান এবং নে উইন মিলে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ভিত্তিক সম্প্রদায়ের সাথে আলাপ-আলোচনা করে পশ্চিমা ধাঁচের গনতান্ত্রিক মডেল অনুকরণ করে ৫০ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত বার্মায় একটি শান্তিপূর্ণ দেশ গড়তে চেয়েছিলেন । নানান ধরনের সম্পদে ভরপুর অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত দেশটিতে বিদ্যমান ১৩৫ টির মত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নেতাদের সাথে মিলিত হয়ে পাংলং সমজোতা দলিল ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ তারিখে সাক্ষর করা হয় । কিন্তু বিধি বাম! এর কিছুদিন পরই সঙ্গী সাথী সহ আং সান’কে হত্যা করা হয়। সাধনটা লাভের মাত্র ৬ মাস পূর্বে এ ঘটনা ঘটে। নে উইন ক্ষমতা লাভ করেন। গণতান্ত্রিক সমাজে া ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় । মিলিটারি একনায়কতন্ত্র বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে। কয়েক বছরের জন্য শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচি জন্সাধ্রনের ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন কিন্তু সামরিক জান্তা তাঁকে ক্ষমতা চ্যুত করে । দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার পর আন্তর্জাতিক ছাপে মুক্ত হলে ও সম্প্রতি তিনি আবার ও আদালতের রায়ে নিজ গৃহে দু বছরের জন্য অন্তরীনাবদ্ধ হয়েছেন।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মলগ্নে জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের সাথে রোহিঙ্গারা আরাকানকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে জোরালো প্রচেষ্টা চালালে ও তা সুফল বয়ে আনেনি বরং এহেন তৎপরতা মূল জনগোষ্ঠী থেকে মানসিকভাবে তাদের আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। থেরাভেদা বৌদ্ধরা সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে লেগে যায় । প্রথম পর্যায়ে কট্টরপন্থী থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও তাদের ভিক্ষুগণ একজোট হয়ে ওঠে পড়ে লাগে আরাকানের শহর-বন্দরে ব্রিটিশদের আনুকূল্যে পাওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা নস্যাৎ করে দিতে। প্রশাসনের সহযোগিতায় এতে তারা বহুলাংশে সফলকাম ও হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলে তারা জাতীয়তাবাদের শ্লোগান ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্যাতন শুরু করে। উল্লেখ্য যে আরাকানে রাখাইনদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এ কারণে তারা বরাবরই বর্মিদের আস্হাভাজন। যদি ও রাখাইন সম্পদায়ের সংখ্যা ৩ মিলিয়নের কিছু বেশী সামরিক বাহিনীতে তারা প্রায় ৩০ শতাংশের মত। রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্থান নেই কারণ তারা ১৯৮২ নাগরিকত্ব আইনে বার্মার নাগরিক নন। আরাকানে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে নাসাকার অভিযানে অনেকেই নাফ নদী ও পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে বাংলদেশে প্রবেশ করে। উখিয়াতে এদের জন্য ক্যাম্প করা হলে ও প্রচুর সংখ্যক কক্সবাজার, সাতকানিয়া, চকরিয়া এমনকি চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় পালিয়ে আসে। এদের অনেকেই আর আরাকানে ফিরেনি বলে অনুমান করা হয়।
বার্মায় রোহিঙ্গা নির্যাতন কাহিনী অনেক দীর্ঘ। সঙ্কখেপ রূপ অনেকটা এ রকম- রোহিঙ্গা এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় ১৯৪২ সালের দাঙ্গা বা রায়টের সময় থেকেই। রোহিঙ্গাদের মতে ষ্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট কাউন্সিল (SPDC) সৃষ্টির পর দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি বাড়তে থাকে । অনেক বিশ্লেষকের মতে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় ‘রোহিঙ্গা বোট পিপল ক্রাইসিস’ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে মিয়ানমার সরকার বিশ্বের নজর ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে এ সঙ্কটের সৃষ্টি করে। ৭ম-৮ম শতাব্দীতে জাহাজ দুবে যাওয়া আরব বনিকদের আগমনের মধ্য দিয়ে যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক , ও সামাজিক মেলবন্ধন শুরু হয়েছিল তা মোগল ও বাংলায় সুলতান আমলে ঠিক ছিল যদিও আরাকান অনেক বছর চট্টগ্রামের কিছু এলাকা দখল করে রেখেছিল।
আরব বঙ্কদের আরাকানে আশার ফলশ্রুতিতে স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দুদের সাথে বিবাহ বন্ধন, ধর্মান্তর ইত্যাদির কারণে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এ বিষয়টি নিয়ে পূর্ববর্তী সংখ্যায় আলোকপাত করা হয়েছে। আরাকান ও আকিয়াবকে কেন্দ্র করে এ সম্প্রদায়ের শেকড় বার্মায় প্রোথিত হয় এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বিকশিত হতে শুরু করে । বিংশ শতাব্দীতে রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের (যারা মগ নামে পরিচিত ছিল) শত্রুতা ও প্ররোচনা বর্মি শাসকদের মন ও মানসিকতা রোহিঙ্গাদের প্রতি বিষিয়ে তোলে । এক পর্যায়ে আরাকানের বিভিন্ন স্থাপনা , শহর-বন্দরের হাজার বছর ধরে চলে আসা আরবি-পারসি নাম ও বদলে দেয় সামরিক জান্তা । আকিয়াবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সিত্তউই (Sittwe)।
১৭৮৪ সালে আরাকান বার্মার পদানত হলে রোহিঙ্গা সমস্যার সূত্রপাত হয় তবে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ নারকীয় রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত থেকে বার্মাকে আলাদা করে দিলে আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর নিগ্রহ নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষ সমর্থন করায় জাপানি ও বর্মিরা রোহিঙ্গাদের কচুকাটা করে। মগজাতিগোষ্ঠী যাদের একসময়ে বৃত্তি ছিল জলদস্যুতা তারাই আরাকের থেরাভেদা রাখাইন বৌদ্ধ সম্রদায়। বার্মা সরকারে তাদের রয়েছে বিপুল আধিপত্য কারণ সেনাবাহিনীতে মোট সদস্যের শতকরা ৩০ ভাগই এ সম্প্রদায়ের। সরকারের হয়ে আরাকানে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনে থেরাভেদা রাখাইন বৌদ্ধ এবং তাদের ভিক্ষুরা প্রক্সি ভূমিকা রাখছে। ১৯৪২র রায়ট, ১৯৭৮ এর ড্রাগন কিং অপারেশ এবং ১৯৯১-৯২ সময়ে রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান জেনোসাইড সমতুল্য বলে জাতিসংগ, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মনে করে। সামরিক জান্তা ও রাখাইনদের যৌথ পরিকল্পনা ও নিষ্ঠুর অভিযানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল ও বহিষ্কার ফুলস্পিডে এগিয়ে চলছে। রোহিঙ্গারা এখন রাষ্ট্রবিহীন একটি সম্রদায় যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসমান অবস্থায় দিনাদিপাত করছে ।
Posted ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh