বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও রাজনৈতিক মেরুকরণ

ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ   |   বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি ২০২২

বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও রাজনৈতিক মেরুকরণ

জগৎ শেঠের অধস্থন পুরুষদের, অর্থাৎ মারোয়াড়ী এবং হিন্দু কায়স্থ শ্রেণীর কতিপয় সংখ্যক ধনী ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্বালে পূর্ব বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বলতে যা কিছু ছিল তার মালিকানা ভোগ করছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ও এদের অনেকেই থেকে গিয়েছিল; কেউ কেউ অংশীদার নিয়ে এ গুলো পরিচালনা করতো। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারীর পূর্ব পর্যন্ত মারোয়াড়ী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দেখা যেত।

তাদের শূন্য স্থান পূরণে বাঙ্গালী বিত্তশালী পরিবারগুলোর কেউ কেউ এগিয়ে আসে তবে অত্যন্ত ধীরলয়ে । প্রচুর জমিজমা ও পারিবারিক ঐতিহ্যকে পুঁজি করে এদের কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে পড়ে এবং শিল্প কারখানা কিনে নেয়। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র চালু হলে গ্রামে একটি সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয় । পাটের বাজার অস্বাভাবিক তেজী হওয়ার কারণে গ্রামীণ এই কাঁচা পয়সা ওয়ালা নতুন মধ্যবিত্তরা ব্যবসা বাণিজ্যে ও ছোট শিল্পে বিনিয়োগ করে অচিরেই ধনিক শ্রেণীতে উন্নীত হয়। ১৯৬০ সাল নাগাদ মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা দীক্ষার বিস্তার হলে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্প্রসারিত হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায়, বিশেষত আইয়ুব খানের বুনিয়াদী গণতন্ত্র, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে প্রণোদনা প্রাপ্তি ইত্যাদির ফলশ্রুতিতে গ্রামে ও শহরে একটা পুঁজিবাদী আবহ সৃষ্টি হয় যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দেয়া হয়েছে। পল্লী পূর্ত কর্মসূচী গ্রামে গঞ্জে রাস্তা ঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি, ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন, কৃষি সমবায় ইত্যাদি এ আবহে কিছুটা হলে ও পুঁজি গঠনে সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ পরোক্ষ ভাবে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে গ্রামে সুবিধাবাদী উঠতি ধনীদের পুঁজি সংগ্রহে সাহায্য করে।


১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার ফলশ্রুতিতে মারোয়াড়ী ও হিন্দু ব্যবসায়ীরা পূর্বপাকিস্তান থেকে তাদের পুঁজি সরিয়ে নেয়। এদিকে শত্রু সম্পআইনের সুযোগ নিয়ে সরকারি মদদে একটি নব্য ধনিক শ্রেণী গড়ে ওঠে। এ সময়েই প্রায় ৮০টির মত পাঁট কল, বেশ কয়েকটি বস্র ও চিনি কল মূলত অবাঙ্গালিদের মালিকানায় আসে যায় । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে অবাঙ্গালি মালিকরা পাকিস্তানে চলে যায়। জাতীয়করন করা হলে সরকার নিয়োজিত প্রশাসকরা দেদারসে লুটপাট করে বিপুল অর্থের মালিক বনে যায়।

এ কালো টাকা সরকারের একটি দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর সহযোগিতায় বিনিয়োগ করা হয় অবৈধ ব্যবসা, শিল্পকারখানা নির্মাণ, ক্রয় ইত্যাদি কাজে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও সরকারের অভ্যন্তরে থাকা দুষ্টচক্রের সাহায্যে তারা হরেক ধরণের অবৈধ কাজকর্ম, যেমন লাইসেন্স পারমিট ক্রয়-বিক্রয়ে ড়রদুর্নীতি, মজুতদারি, চাঁদাবাজি, কন্ট্রাক্টটারি, কালোবাজারি ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়ে প্রচুর টাকা-পয়সা কামাই করে। নতুন গজানো এই ধনিক গোষ্ঠীটি ক্ষমতাসীন শাসক দলের সহযোগিতা পেয়ে পরিপুষ্ট হয় এবং অতি দ্রুত এদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে নিহত হলে সুবিধাপ্রাপ্ত নব্য ধনিক শ্রেণীটি কোন দুর্বিপাকে পড়েনি বরং জিয়া, সাত্তার ও এরশাদ সরকার এদের লালন করতে প্রলুব্দ করে দলবদল ও মোটা দাগের চাঁদা দেয়ার শর্তে। এরশাদের আমলে এদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকগুণ বেড়ে যায়। বৈদেশিক সাহায্য, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধাভোগ, একশ্রেণীর আমলাদের সুনজর ও সময়ে সময়ে এনজিওদের আনুকূল্য পেয়ে এরা নিজেদের সুসংহত করতে সমর্থ হয়।


বাংলাদেশর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত সময়ে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে গণতন্ত্র বিকাশে প্রচুর সমস্যা, সংসদীয় পদ্ধতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সীমাহীন ত্রুটি বিচ্যুতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ইত্যাদি সত্ত্বে ও বাংলাদেশ এখন আর দারিদ্র প্রপীড়িত, বিদেশী সাহায্য নির্ভর রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানের উপনিবেশিক নাগপাশ থেকে নয় মাস যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি এখন স্বনির্ভর দেশে পরিণত হওয়ার পথে প্রশংসনীয় ভাবে আগুয়ান। ২০১৯ সালের প্রথম দিকেই বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম অতি-দ্রুত উন্নয়শীল দেশের কাতারে স্থান করে নেয়। সত্যিকারের জি ডি পি ৮.৩% বেড়ে যায়। বিগত কয়েক বছরের এ হার নিন্মরূপ : ২০১৭-১৮ ৭.৯%; ২০১৮-১৯ ৮.২%; ২০১৯-২০ ৫.২%; ২০২০-২০২১ ৬.৮%।

অর্থনীতির সকল সেক্টরেই এ বৃদ্ধি লক্ষণীয়। সবচেয়ে বেড়েছে শিল্প খাতে যা বর্তমানে ৩৫.৬৬%। দারিদ্র্যের হার কমেছে। ২০১৯ সালে ২০.৫ শতাংশ দাড়িয়েছিল। ২০২০-২১ সালে মাত্র ৬% লোক প্রকট ভাবে দারিদ্র প্রপীড়িত। (পরিসংখ্যান উইকিপেডিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)।


বাংলাদেশে শিল্প খাতে যে উন্নয়ন ধারা লক্ষ্য করা যায় তার পেছনে সহজ লভ্য শ্রম শক্তি যা নামকা ওয়াস্ত মূল্যে পাওয়া যায় তার উল্লেখ করা করা প্রয়োজন। মালিক পক্ষ রপ্তানি মুখি বাণিজ্য থেকে বিপুল লাভবান হয় কিন্তু শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয় খুবই নিন্ম হারে।

এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিকদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় অগ্রগামী । ঔষধ তৈরি, চামড়াজাত শিল্প, শিপ বিল্ডিং ইত্যাদি ও পিছিয়ে নেই। কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করণ, মেশিন প্রস্তুত এসব ক্ষেত্রে ও শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি দেয়া হয়না। দালানকোঠা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, আই সি টি পাঁট ও সিরামিক শিল্পে অবস্থা তেমন ভিন্ন নয়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে উপযুক্ত নীতিমালা ও সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যাগুলো দূর করা তেমন কঠিন হওয়া কথা নয়। তবে শিল্পপতি পরিবেষ্টিত সরকার পরিচালনা কাঠামোতে এ কাজ সহজ নয়। আবার, শিল্পায়ন তরান্বিত করার জন্য বিত্তবান ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সরকারে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা খুবই প্রয়োজন। একসময় আইন পেশার লকজনের পদভারে রাজনৈতিক অঙ্গন মুখরিত থাকতো। এখন ও আছে তবে শিল্পের মালিক ও ব্যবসায়ী এখন সংসদ ও সরকারে বেশ ভাল অবস্থানে আছেন । দেশে শিল্প বিকাশে এদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়নের কোন বিকল্প নেই । বাংলাদেশে রাজনীতিতে মেরুকরণের এ ধারাটির সৃষ্টি হয়েছে বিগত ৮-১০ বছরে। এ প্রক্রিয়ার বিপরীতে আরেকটি ধারা প্রতিভাত হচ্ছে। ধনীক শ্রেণীর সংখ্যা ও প্রাধান্য বাড়ার সাথে সাথে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে । দারিদ্র্য কমলে ও ধনী-গরীব ফারাক বাড়ছে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার যে অভাব পরিলক্ষিত হয় তা হিতাকাঙ্ক্ষীদের ভাবিত করে । যেমন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। সুস্থ্য নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের অভাব পদে পদে পরিলক্ষিত হয়। দেশে কোটিপতির সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে । তবে, আয় কর পরিশোধ করে এমন লোকের সংখ্যা সে তুলনায় কম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরিসংখানে জানা যায় যে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ট্যাক্স থেকে আয় জি ডি পির মাত্র ৯.১ শতাংশ ছিল। সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ, নন-পারফরমিং ঋণ বা এন পি এল ইত্যাদি সমস্যা বেড়েই চলেছে। লুণ্ঠন যে ভাবে চলছে তা রীতিমত ভয়াবহ।

সরকার অত্যন্ত উদার ভাবে ইনভেস্টমেন্ট প্রণোদনা দিচ্ছে শিল্প ও রপ্তানি খাতে। এ দু খাতেই সরকারের কৌশল ও নীতিমালা বেশ ফলপ্রসূ । মোদ্দা কথা হল এত সবের পর দারিদ্র কিছুটা কমলে ও ধনী গরীব ফারাক প্রকট।

সমঝোতা, সহনশীলতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সুস্থ মতবিনিময় পরিবেশ সৃষ্টি, পারস্পরিক সম্মানবোধ এ সবই গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ও গতিশীল এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য । গণতন্ত্র বিকাশে সহায়ক মূল্যবোধের পরিস্ফুটন ও বিকাশ যথাযথ ভাবে হলে দেশটি বিশ্বে সম্মানের উঁচু আসনে সমাসীন হবে এতে দ্বিমতের তেমন অবকাশ নেই।

advertisement

Posted ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি ২০২২

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6244 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1303 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1148 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.