আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০২২
সম্প্রতি ডায়ান অ্যাকারমেন এর দি সোশ্যাল সেন্স (Diane Ackerman- The Social sense) শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করে রসনা তৃপ্তি মেলে এমন খাদ্যাভাসের সাথে মানব সভ্যতার সম্পর্ক নিয়ে সংক্ষেপে কিছু তথ্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করার প্রয়াস থেকে এ লেখা । অধ্যাপক ও সাংবাদিক অ্যাকারমেন ১৯৯০ সালে তার প্রকাশিত A Natural History of the Senses গ্রন্থে এ প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ।
লেখিকা একজন প্রথিতযশা সমাজ বিজ্ঞানী । ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে । উৎসাহী পাঠকদের জন্য তাঁর পুস্তকের একটি নমুনা তালিকা হতে পারে, আমার ধারনায়, নিন্মরূপ : A NATURAL HISTORY OF LOVE (1994), RAREST OF THE RARE (1995), A SLENDER THREAD (1996), I PRAISE MY DESTROYER (1998), DEEP PLAY (1999), CULTIVATING DELIGHT: A NATURAL HISTORY OF MY GARDRN (2001). Zuvi A Natural History of the Senses (1990) গ্রন্থটি সুবিখ্যাত । এখান থেকেই Social Sense অংশটি পিবিএস টেলিভিশন Mystery of the Senses নামের জনপ্রিয় সিরিজে প্রচার করেছে ।
রসনা তৃপ্তির জন্য প্রাচীন যুগে রোমানরা হাজারো রকমের খাবার তৈরি করত এবং এতে আবিশ্যিকভাবে যৌন উদ্দীপক বিশেষ খাবার ও থাকত । ভোজ সভায় প্রতিযোগিতা হত কে কত উপাদান, সংখ্যা ও উপাদেয় খাবারে টেবিল সজ্জিত করতে পারত । রোমান সমাজের অবক্ষয় ও সভ্যতার পতনের পেছনে অতিভোজন ও অতিরিক্ত কাম প্রবণতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল বলে অ্যাকারম্যান মনে করেন । এসব অভ্যেস থেকে যে রাজ ও অভিজাত সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল তা সম্রাট নীরুকে বাঁশী বাজানোর নেশায় আত্মমগ্ন রেখেছিল , রোম নগরী যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তা দেখে কোন ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা ও মাথায় আসেনি । রোমান সমাজ ও সভ্যতার পতনে রসনা তৃপ্তির জন্য ভোজ ও বিকৃত যৌন লালসা ও বিনোদন অনেকাংশে দায়ী ছিল বলে অনেকে মনে করেন । খৃস্ট ধর্মাবলম্বীদের সালভেসন বা মুক্তি লাভের জন্য রসনা সংযত রাখার জন্য যে কঠিন নিয়ম কানুন তা রোমান সমাজ ও সভ্যতার পরিনতির পাঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করে । ইসলাম ধর্মে ও খাদ্য গ্রহণে কৃচ্ছতা ও শেয়ারিং এর উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে ।
আমাদের নবী করিম নিজের জীবনে এ নিয়ে অনেক উদাহরণ রেখে গেছেন । খেজুর এবং উটের দুধ সে সময় আরবদের জীবনধারণের প্রধান খাদ্য ছিল। সময়ের বিবর্তনে সহজ, সরল জীবন যাপনে পরিবর্তন এসেছে । দুম্বা, মেষ, উটের মাংস খাদ্য তালিকায় স্থান পাওয়ার পাশাপাশি আমির, শেখ ও রাজা-বাদশারা বিশাল হেরেমের সাথে খাদ্যে বিলাসিতা যোগ করেছে। আস্ত দুম্বার রোস্ট ছাড়া ও নানান রকমের খানাপিনা ছাড়া ভোজ হয়না । সেই প্রাচীন রোমান সমাজের কায়দায় খাদ্যদ্রব্যে রসনা তৃপ্তির সাথে সাথের যৌন উদ্দীপক ফলমূল, পানিয় ও খাবার সামগ্রী পরিবেশ করা হয় । যৌন ক্ষুধা এবং দৈহিক ক্ষুধা একসাথে যে চলে তা সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃত । এই দুই ক্ষুধা নিবারণের ব্যাপারে ডায়ানা অ্যাকারমেন প্রচলিত ও অপ্রচলিত অনেক ধরনের ফলমূল, খাদ্যদ্রব্য, জন্তু-জানুয়ার, পাখী, মাছি, মাকড়সা, বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পানীয় ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন । প্রাচীন ভারতীয় সাধক ও গুরু বাৎস্যায়ন সহ প্রাচ্য দেশ সমূহের মুনিঋষিগণ যেখানে কামনা উদ্দীপনে কল্পনা শক্তির চেয়ে শ্রেয়তর কিছু নেই বলেছেন সেখানে প্রাচীন রোমান মিশরীয় সভ্যতায় রিপু জাগরণে বিশেষ খাবার গ্রহণ ও পানীয় হিতের চেয়ে অনিষ্টই করেছে বেশী ।
বাঙ্গালীদের খাদ্যাবাসে বিপুল পরিবর্তন এসেছে । প্রচুর ভেজাল সত্ত্বে ও বিলাসবহুল বাঙ্গালী আথিতেয়তা এখন আর পাঁচ পদ বা পঞ্চ ব্যঞ্জনে সীমাবদ্ধ নেই । বিশ থেকে পঁচিশ-তিরিশ পদ ছাড়া মেহমানদারি আয়োজনের প্রথা উঠে গেছে বললে অতিশয়োক্তি হবে বলে মনে হয় না । বিবাহ-শাদীতে তো বটেই, যে কোন মেহমানদারিতে ভাত, পোলাউ, বিরিয়ানি, রুটি,পরোটা, অন্তত দশ-বারো পদের মাছ ও মাংসের তরকারি, কয়েক পদের ভর্তা, পাঁচ-সাত পদের সব্জি, রকমারি ডাল, কয়েক ধরনের আচার, মিষ্টি তিন-চার ধরণের, দই ইত্যাদি নিন্ম মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উঁচুবিত্তবানরা মেহমানধারিতে সাধারণত রাখে ।
বিয়ে-শাদী, মেজবান অনুষ্ঠান এ সবে আয়োজন ভিন্ন রকমের হয় । উত্তেজক খাবার-দাবারের ক্ষীণ প্রচলন একটি মহলে থাকলে ও তা অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে করা হয় এবং জনমানুষে এর বিস্তৃতি নেই বলেই মনে হয় । তবে, ডায়াবেটিস বাংগালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আশঙ্কাজনক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে ।
এ অবস্থার কারণ হিসেবে মূলত আমাদের চাউল/ভাত ভিত্তিক খ্যদ্যাভাসকে দায়ী করা হয়। রসনা তৃপ্তির ব্যাপারটি যেমন ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করে, একই মুদ্রার অন্য পিঠ হল মজাদার খাবার-দাবার অতি মাত্রায়, যাকে ভূরিভোজন বলা হয়, তা যতই উপাদেয় ও মনোরঞ্জক বা চিত্তবিনোদক হোকনা কেন, অসুখ-বিসুখের মূলে ও এ কারণটি কোন না কোন ভাবে নিহিত থাকে । স্বাস্থ্য সম্মত জীবন যাপনে রসনা তৃপ্তি ও কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ এ দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কোন বিকল্প নেই ।
Posted ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh