আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
২০২০ সাল পুরোটাই ভ্লাদিমির পুতিনের বহির্বিশ্ব সংক্রান্ত রাজনীতির সমস্ত মনযোগ ছিল বিভিন্ন কায়দায় যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট নিবাচন প্রভাবিত করা যাতে জো বাইডেন কোন অবস্থায়ই ক্ষমতায় আসতে না পারেন। ট্রাম্পকে নিত্যই নানাভাবে বুদ্ধি যোগান দিয়ে, তার স্বপক্ষে প্রচার মাধ্যম ও কেজিবি’র তৎপরতা, ষড়যন্ত্র, বানোয়াট তথ্য, মিথ্যাচার ইত্যাদি প্রয়োগ করে ও বিফলকাম হলে ভিন্ন ধরনের কূট কৌশলের আশ্রয় নেন পুতিন। স্পাই মাস্টার থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া মানুষটি আমেরিকার অভ্যন্তরে গ্যাস এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করা সহ বিদেশ বাণিজ্য বিঘ্নিত করার হীন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাশিয়ার অপরাধী চক্র এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দেন। কলোনিয়াল পাইপ লাইন এবং জেবিএস ফুডস এর মাংস প্রক্রিয়াজাত কারখানাসমূহের কাছে চাঁদা বা রেনসম চাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মেনে নিতে পারেনি। বাইডেন প্রশাসন এতে পুতিনের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে বলে ধরে নিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০২১ সালের মে মাসে সাইবার হ্যাকাররা ছয় দিন কলোনিয়াল পাইপ লাইনের কম্পিউটার অকেজো করে রেখেছিল। তাই হয়তো জেনেভা সম্মেলনে জি-৭ সভার বাইরে হোটেলে বাইডেন সুনির্দিষ্ট ভাবে পুতিনকে বলে দিয়েছেন যে আমেরিকার সাইবার সক্ষমতাকে খাটো করে দেখা রাশিয়ার জন্য ঠিক হবেনা মোটেও। পুতিনকে এভাবে সতর্ক করায় মিত্র দেশগুলো ও আশ্বস্ত হয়েছে যে তাদের নিরাপত্তা বিধানে যুক্তরাষ্ট্রের যে সাইবার সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন তা আছে।
বাইডেন শুধু একজন ঝানু সমযোতাকারীই নন, একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও তিনি। আমেরিকার কংগ্রেসে দীর্ঘদিন তিনি সদস্য ছিলেন; সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে ও কাজ করেছেন, তদুপরি তার রয়েছে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমেরিকা ও রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। এ সব তিনি কাজে লাগাতে সমর্থ হবেন এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
তবে স্পাই মাস্টার পুতিনের চাল অনেক সুনিপুণ; অনেক সময় বুঝা বেশ কঠিন। চতুর ও গোয়ার্ এই মানুষটি কৌশলের মারপ্যাঁচে অনেক ঝানু রাজনীতিবিদের ও ঘোল খাইয়ে দেন।
প্রেসিডেন্ট বুশ ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ দু’জন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্টের সাথে তার সম্প্রীতির যে সম্পর্ক ছিল তাতে অবাক না হয়ে পারা যায়না। ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর জর্জ ডব্লিও বুশ পুতিনকে তার টেক্সাস রেঞ্জে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে সময় বলেছিলেন পুতিনকে তার কাছে বিশ্বাস করার মত একজন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্বনেতা মনে হয়। আর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো পুতিনকে তার ঘনিষ্ঠ একান্ত বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুই মনে করতেন। ক্রিমিয়া জোর করে দখল করে যে মানুষটি তার এক মাত্র আকাঙ্ক্ষা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশগুলোকে আবার ও ছলে বলে কৌশলে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে পূর্বেকার মত বৃহৎ শক্তিশালী দেশ হিসেবে হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনা। ট্র্যাম্পের আমলে পুতিন ইচ্ছেমত মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য করেছে; ব্যবসা-বানিজ্যে ও যত্রতত্র বাধাহীন ভাবে করেছে। আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বানিজ্য ইত্যাদি ব্যাপারে যে সমস্ত বিধি-নিষেধ বারাক ওবামা ও পূর্ববর্তী সরকার আরোপ করেছিল তার অনেকগুলোই ট্র্যাম্পের আমলে তুলে নেয়া হয়। হৃত গৌরব ও বিশ্বের কাছে ভাবমূর্তি পুনস্থাপনের জন্য সিরিয়া সহ কয়েকটি দেশে রাশিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। বাইডেন যে ধাঁচের মানুষ তাতে বলা যায় তিনি এত ছাড় দিবেন না । ধীরস্থির এ প্রেসিডেন্টকে নরম ভাবাটা ঠিক হবেনা ।
পুতিনের মত দুর্দান্ত চরিত্রের না হলে ও দেশ ও মিত্রদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে জো বাইডেন পুতিনকে খুনি বলতে দ্বিধা করেননি। ২০২১ এ এবিসি টেলিভিশনের একজন নিউজ ইন্টারভিউয়ারের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট এ বিশেষণটিই ব্যবহার করেছিলেন। ক্রিমিয়ার পর ইউক্রেন নিয়ে এখন যে খেলা শুরু করেছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট তা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও মিত্ররা নিচ্ছেন তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের আশেপাশের মিত্র দেশগুলোতে সাড়ে আট হাজার সেনা মোতায়েন করা ছাড়া ও ন্যাটো ও মিত্র দেশগুলোকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। কিয়েভের লাগোয়া বর্ডারে মোতায়েন করা মস্কোর লক্ষ সেনবাহিনীর তুলনায় স্বল্প মনে হলে ও প্রায় ৪০ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা ও যুদ্ধসাজে সীমান্তে প্রস্তুত রয়েছে।
রাশিয়ার নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্র আমেরিকার চেয়ে বেশী কারণ কোন চুক্তি এগুলো সংখ্যা এবং ব্যবহার সীমিত করেনি। বাইডেন শুধুমাত্র নিউ স্টার্ট নামীয় কোল্ড ওয়ার সময়কালের একটি চুক্তি পাঁচ বছরের মেয়াদে নবায়ন করেছেন। সাইবার যুদ্ধে ও রাশিয়ার অভিজ্ঞতা আমেরিকার চেয়ে বেশী। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন স্থাপনা, অফিস, ব্যাঙ্ক, এমনকি ইলেকট্রিকাল গ্রিড নেটওয়ার্ক আক্রমণ করতে সমর্থ হয়েছে এবং দু’টো নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পেরেছে। বিশ্ব বছর ক্ষমতায় থাক্কালিন সময়ে পুতিন পাঁচ জন আমেরিকা প্রেসিডেন্টের সাথে ডিল করেছেন তবে বাইডেন বাকিদের চেয়ে ভিন্ন চরিত্রের। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, ন্যাটো এবং বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো সমর্থন ও সহযোগিতা দিলে ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার কি পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসন রোধ করতে পারবে ?
৪৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনকে আক্রমন করে পদানত করার চেষ্টা করলে আমেরিকা, ন্যাটো, ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে । তাছাড়া, ইউক্রেনের অভ্যন্থরে এ সময়ে পুতিনের তেমন কোন নির্ভরযোগ্য বন্ধু নেই যারা অতীতে তাকে সমর্থন দিয়েছে, তার পক্ষে প্রোপাগান্ডা করে জনমত তৈরি করতে সদা সচেষ্ট ছিল। এমনটি হতে পারে যে এ সব যুগপৎ চিন্তা এবং বাস্তবতা ও নিশ্চয়ই পুতিনকে নিরস্ত রাখতে কাজ করবে। এমতাবস্থায় ডিপ্লোম্যাটিক সমাধানের পথ বেছে নেয়া ছাড়া তেমন গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না। আমরা আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ ও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে নগ্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ । সাইবার ওয়ারফেয়ার এ রাশিয়ার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আমেরিকাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে কাজটিতে রাশিয়ার সমকক্ষ বর্তমান সময়ে কেউ নেই তা হল বিভ্রান্তি বা প্রহেলিকা সৃষ্টি করে বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দেয়া। এ ধোঁকাবাজি খেলায়, যাকে ডিজইনফরমেশন বলা হয়, তা পুতিন ও কেজিবি অত্যন্ত পারঙ্গমতার সাথে করতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে আমেরিকা-রাশিয়া সম্পর্ক আবারো সেই পুরনো শীতল বা স্নায়ু যুদ্ধ যুগে ফিরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ বিকল্পটি ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
Posted ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh