আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
আওয়ামী লীগ নেত্রী, সাবেক মন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আওয়ামী লীগের অসময়ে তিনি তাঁর দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং দলে তাঁর মর্যাদপূর্ণ অবস্থান ছিল। কিন্তু এই ত্যাগী বর্ষীয়ান নেত্রীকে নিয়ে সংবাদপত্রে তেমন লেখালেখি না হওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি কোনো দলের কউ নই। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবাদে কারও সাথে আমার সামান্য স্মৃতিময় ঘটনা থাকলেও আমি তাদের মৃত্যুতে আমি তা স্মরণ করার চেষ্টা করি।
অনেকের সঙ্গে দেশে হরহাশোই দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কখনো কথাবার্তা হয় না, পরিচয় হওয়া তো দূরের কথা। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়, কথাবার্তা হয়েছিল আকাশপথে ঢাকা থেকে ৪,৩৮৬ মাইল বা সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের পাশেই সুইডেনের ছোট্ট মনোরম মালমো সিটিতে। ২০০০ সালের মে মাস। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (United Nations Environment Programme-UNEP) এর প্রথম গ্লোবাল মিনিস্টারিয়েল এনভায়রনমেন্ট ফোরামে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে সেখানে যান পরিবেশ মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরী এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি কামাল নাসের চৌধুরী (যিনি পরবর্তীতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে যান এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে তিনি মুজিব জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন) কামাল নাসের চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তিন বছরের জুনিয়র। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘আপনি’ ও ‘কামাল ভাই’ বলতে শুনে আমার ব্যাচমেট বন্ধু কবি হাসান হাফিজ আমাকে চিমটি কাটেন, ‘ওকে আপনি আপনি বলছেন কেন, আমাদের জুনিয়র।’ আমি বলি, ‘আমি সাধারণত কাউকে তুমি বলি না।’
বাইশ বছর আগে অনলাইনে যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মতো এগোয়নি। মালমো ও কোপেনহেগেনের অবস্থান বাল্টিক সাগর থেকে বের হয়ে আসা একটি সরু উপসাগরের এপার ওপার। এক সিটি থেকে আরেক সিটিতে যেতে মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। ম্যাপ দেখে ট্রাভেল এজেন্টকে বহু বলার পরও তিনি কোপেনহেগেন থেকে মালমো যাওয়ার উপায় নেই বলে স্টকহোম থেকে কানেকটিং ফ্লাইটে মালমোর টিকেট দিয়েছিলেন। এর ফলে আমাদের ওপর বেশ ধকল গেছে। বিশেষ করে স্টকহোমে পৌছে আমরা লাগেজ না পাওয়ায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছিল। মালমো’র হোটেলে আমাদের রুম পাঁচতলায়। কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে বিমান ওঠানামা দেখা যায়।
সম্মেলনস্থলে যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা ছিল। ২৯ মে ২০০০ সকালে আমরা সম্মেলনস্থলে পৌছে লাইন ধরে গলায় ঝোলানোর আইডি সংগ্রহ করি। লবিতেই দেখা মেলে পরিবেশ মন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তাঁর পিএস কামাল নাসের চৌধুরীর। মন্ত্রীর পায়ে ব্যথা বলে লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে পা ফেলছিলেন। সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে তারা দু’জনই এসেছেন। সে তুলনায় বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিনিধিদল অনেক বড়। বেশ কিছু এনজিও কর্মকর্তা কনফারেন্সে এসেছেন।
শরীফ শাহাবুদ্দিন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ‘আপা, আপা’ বলে জড়িয়ে ধরেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। আমি বাংলার বাণীর নিউজ এডিটর জানার পর আমাকে বলেন, ‘মুকুল (নির্বাহী সম্পাদক শফিকুল আজিজ মুকুল) তো আমার খবর ছাপে না। কনফারেন্স ছাড়াও সুইডেন আওয়ামী লীগের কিছু প্রোগ্রাম আছে, কোনো খবর যাতে বাদ না পড়ে।” বাংলার বাণী বলে তার দাবী থাকারই কথা। কামাল নাসের চৌধুরীর কাছে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কর্মসূচি জেনে নেই।
কনফারেন্সে বিভিন্ন সেশনে গিয়ে বসা ও বক্তৃতা শোনা ছাড়া আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই। সম্মেলনস্থলে প্রবেশের সময় একজন কালো বোরখাধারী নারীকে দেখেছিলাম। তাকে ঘিরে মানুষের ভিড় দেখে জানতে চেষ্টা করি, তিনি কে! ১৯৭৯ সালের ইরানের বিপ্লবের পর প্রথম নারী মন্ত্রী মাসুমেহ ইবতেকার মেরি (Masoumeh Ebtekar Mary), তিনি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী (তিনি ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব পালন করেন তিন বার (২০১৭-২০২১)। পেশাগতভাবে তিনি এক ্িবশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সায়েন্স ও ইমিওনোলজি বিভাগের প্রফেসর। আশির দশকে তিনি তেহরান থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক কায়হান ইন্টারন্যাশনালের প্রধান সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য আগ্রহী হলাম এবং কোন হলে বক্তৃতা দেবেন জেনে সেখানে উপস্থিত হলাম। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও সেখানে ছিলেন, একই হলে তিনিও বক্তৃতা করবেন। মাসুমেহ ইবতেকারের বক্তৃতায় স্পষ্ট ছিল যে পরিবেশ দূষণ ও এর প্রতিকারের ওপরও তার অনেক পড়াশোনা। আমরা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বক্তব্যও শুনি।
বিকেলে মালমো শহর কেন্দ্রে অবস্থিত ‘কিংসপার্কেন’ অর্থ্যাৎ রাজার পার্ক নামে এক পার্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পুরোনো এক প্রাসাদে কনফারেন্সে আগত বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে আমরাও অংশগ্রহণ করি। প্রাসাদের স্থাপত্য আমাকে মুগ্ধ করে। ওই সময় সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মনজুরুল আলম। তার সঙ্গেও পরিচয় ঘটে। চেহারা ও কথাবার্তায় তাকে আদৌ কূটনীতিকসুলভ মনে হয়নি। নৈশভোজ শেষে সুইডেন আওয়ামী লীগের নেতারা মন্ত্রীকে রাজপ্রাসাদের হাঁটা দূরত্বে একটি স্কোয়ারে নিয়ে গেলেন। স্কোয়ারের মাঝ বরাবর একটি রেস্টুরেন্টে বসালেন। রেস্টুরেন্টের মালিক সম্ভবত যশোহরের এক ভদ্রলোক আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি সুইডেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরদিন তার রেস্টুরেন্টে আওয়ামী লীগের সভা হবে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আমাদেরও আমন্ত্রণ জানান।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী রাষ্ট্রদূত মনজুরুল আলমের কাছে বাংলাদেশ-সুইডেন সম্পর্ক, বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্যের কথা জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত কিছুটা নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তার মতে, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল সুইডেনে এলে অনেক সময় সুইডিশ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি নিজেও উপস্থিত থাকেন। তিনি বলেন, সুইডেনের মন্ত্রীরা পর্যন্ত ঢাকার ‘সুইডেন আসলাম’ এর কথা জানে, যা ব্যবসার আলোচনার পরিবর্তে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের আলোচনায় গড়ায়। আমরা এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। রাষ্ট্রদূত চলে যাওয়ার পর ইত্তেফাকের গিয়াস ভাই (মরহুম) সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে বলেন, ‘আপা, সুইডেনের মত উন্নত দেশে এমন আনইমপ্রেসিভ অ্যামবেসেডরকে নিয়োগ দিলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোনোদিন উজ্জ্বল হবে না। আপনি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন এই অ্যামবেসেডরকে আফ্রিকার কোনো দেশে নিয়োগ দিতে।’ মন্ত্রী হাসেন, ‘আমি চাইলেই কী সব হবে নাকি? সবকিছুর একটা প্রক্রিয়া আছে।’
পরদিন আবারও সম্মেলনস্থলে যাই। দু’একটা সেশনে বক্তৃতা শুনি। ফ্রি খাবার খাই। বিকেলে আওয়ামী লীগের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য সিটি স্কোয়ারে চলে আসি। বাংলাদেশের লোকজন যে দেশেই বসবাস করুক না কেন, যত ব্যস্ত জীবন কাটাক না কেন, প্রায় প্রত্যেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বন্ধন বজায় রাখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কাজ শেষ করে লোকজনের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
কয়েকজন স্থানীয় নেতার বক্তব্যের পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বক্তৃতা করেন। তিনি বরাবর ভালো বলেন, কিন্তু কমসংখ্যক মানুষের সমাবেশে তার বক্তব্য আলাপচারিতার মতো ছিল। সভাশেষে আনোয়ারুল ইসলাম আমাদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করলেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বললেন, খবরগুলো ভালোভাবে দিয়ো। আমি বললাম, আপা দেশে ফিরে বিস্তারিত রিপোর্ট করবো।
মন্ত্রীর হোটেল স্কোয়ারের কাছেই। আমাদের হোটেল একটু দূরে, আনোয়ারুল ইসলাম তার গাড়িতে আমাদের হোটেলে পেেৌছ দিলেন। পরদিন মালমো ছেড়ে স্টকহোমে চলে এলাম। আরলান্ডা এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছিলেন আমার পুরোনো সহকর্মী ও আত্মীয় নিয়ামত উল্লাহ মিয়া। গিয়াস আহমেদ, কামালউদ্দিন সবুজ ও আমি তিন দিনের জন্য তার আতিথ্য গ্রহণ করে বিদায় নিলাম। আমরা যে ফøাইটে দুবাই পৌছলাম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সেই ফ্লাইটে ছিলেন না। দুবাই পৌছে ঢাকার ফ্লাইটে অপেক্ষার সময়ে দেখলাম মন্ত্রী ও তার পিএস কামাল নাসের চৌধুরী অন্য একটি বিমান থেকে নামলেন। কাছে গেলাম, তিনি বললেন, মালমো থেকে আমাকে না বলেই চলে এসেছো। আমরা বললাম যে স্টকহোমে কয়েকদিন বেড়ানোর প্রোগ্রাম ছিল, তাড়াহুড়া করে চলে এসেছি। তার পায়ের ব্যথা বেড়েছে। দুবাইয়ে কয়েকদিন থাকবেন। তাকে বিদায় জানালাম। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে এরপর আমার আর সরাসরি কোনো কথা হয়নি। আল্লাহ তাঁর পরকালীন শান্তি নিশ্চিত করুন।
Posted ১:১১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh