ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট ২০২১
(২য় পর্ব ) : লেখাটির প্রথম পর্বের সমাপনী টেনেছিলাম সালিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আমাদের সময় কেমন ছিল তার অবতারণা। সবশেষে ছাত্র শক্তি দলটির প্রসঙ্গ টেনেছিলাম এই বলে যে দলটি পাকিস্তান কনসেপ্ট এ বিশ্বাস করতো। নেতৃবৃন্দ অনেকের নামই ভুলে গেছি তবে জনাব আসাফউদ্দৌলা, মিজানুর রহমান শেলী , মোহাম্মাদ উল্লাহ, শাহেদ আলি প্রমুখ ভাইদের নাম মনে আছে। আসলে পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই সময়ে এ জাতীয় লেখা অনেকটা জীবনের বাড়তি সময়ের সৃষ্টিসুখ। প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যে নামগুলোর উল্লেখ্য করেছি সেগুলোর মধ্যে শাহেদ ভাই ও মোহাম্মাদ উল্লাহ ভাই যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সিক্ষাবর্ষে সালিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রথমোক্ত জন ডাকসাইটে সিএসপি ও অত্যন্ত উঁচুদরের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। বার্ড এর মহাপরিচালক থাকার সময় তাঁর গান ও সংস্কৃতি বিষয়ক আলাপ আলোচনা বিমুগ্ধ হয়ে শুনেছি। সরকারের সচিব পদ থেকে তিনি অবসরে যান। শেলী ভাই পাকিস্তান কনসেপ্ট এর প্রাণ ছিলেন। ছাত্র জীবনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প সময় চাকুরী করার সময়ে তিনি নিয়মিত মর্নিং নিউজ পত্রিকায় লিখতেন। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ও তাঁর ছিল।
সিএসপি অফিসার হওয়ার পর ও রাজনৈতিক দর্শন ও উন্নয়ন নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। অত্যন্ত উঁচুমানের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। শাহেদ ভাই এক পর্যায়ে ন্যাপ এ যোগদান করেছিলেন বলে জানি। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রফেসর ইমাম আলী (বর্তমানে বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) আমাকে গল্পচ্ছলে বলেছিলেন যে মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে শাহেদ ভাই আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে খ্যাত মাদারীপুরে প্রথমবারের মত ন্যাপের বিশাল জনসভা করেছিলেন। প্রতিপক্ষ নাকি শেখ মুজিবের কাছে এ নিয়ে নালিশ করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে শাহেদ আমার মন্দ বলবে না কস্মিন কালেও। এমনই ছিল তখনকার সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্র নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত। সর্বকালের মত কিছু পচা শামুক ও ছিল যারা সরকারের চর হিসেবে, দালাল হিসেবে কাজ করেছে। তবে অধিকাংশই ছিল সৎ ও ন্যায়-নীতিতে অটল এমন চরিত্রের।
আমার ছাত্র থাকাকালীন সময়ের শেষ দু’বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যেমন, দেশে ও বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে আমূল পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। আইয়ুব-মোনায়েম চক্র ছাত্র তথা প্রগতিশীল গোষ্ঠী এবং বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলন নস্যাৎ করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। এনএসএফ এর গুন্ডা বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খানের পুত্র খসরুর প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের ছাত্রদের যেখানে সেখানে মারপিট করা শুরু করে। খোকা-পাচপাত্তুর (সাইদুর)বাহিনী এস এম হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে, মধুর ক্যান্টিনে সন্ত্রাস শুরু করলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার আয়োজন শুরু হয়। সালিমুল্লাহ মুসলিম হলে সারোয়ার-মনি-কাল গফুর গং এর অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী একদিন একাই লাথি হাতে ওয়েস্ট হাউজের লনে নেমে তাদের নেমে আসতে আহ্বান জানালে সারোয়ার-মনি সাহস করে দুলাল ভাইয়ের রণমূর্তির সামনে আসতে সাহস করেনি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে আমাদের মাস্টার্স সমাপনী কাম বাৎসরিক ভোজের দিন। থমথমে আবহাওয়া নাকি ছিল সাড়া দিনমান। লিখিত পরীক্ষা এদিনই শেষ তাই অনেকেই হল ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে গিয়েছিল। আমি এ অবস্থা বুজতে পারিনি। একটা কাজে আটকা পরে ঐদিন রাত আটটার পর হলে ফিরে সোজা ডাইনিং হলে ভোজ খেতে ঢুকে যাই। দেখি বন্ধু বুলবুল পাচপাত্তুর ও আরও ক’জনকে নিয়ে জাঁকিয়ে কাওয়ার আসর বসিয়েছে। তাদের টেবিলে রোস্ট এর সোডায় সয়লাব। বুলবুল আমাকে আহ্বান জানালে ও আমি না গিয়ে একটু দূরে আহার শেষ করি। বুলবুলরা ততক্ষণে খেয়ে চলে গেলে আমাকে ডাইনিং হলের এক কর্মচারী বলে তাড়াতাড়ি হলের বাইরে চলে যেতে। আমি রমনার দিকে রওয়ানা দেই। আমার কক্ষের ঠিক পূর্বের কক্ষটি (খুব সম্ভবত ১১৬ নাম্বার) বুলবুলের। দরজা খোলা। আমাকে দেখেই বুলবুল ভিতরে এসতে অনুরোধ জানালে আমি দুকে একটি ক্যাপটেন সিগারেট নিয়ে রুমে চলে যাই ।
দরজা বন্ধ করে একটা গল্পের বই নিয়ে সবে বসেছি তখনই শুনি চিৎকার ও গোঙানির শব্দ। তাড়াতাড়ি লাইট বন্ধ করে বিছানায় বসে আল্লাহর নাম জপ করতে থাকি। কয়েক মিনিটের নীরবতার পর মনে হল আমাকে কে যেন ক্ষীণ স্বরে ডাকছে । সাহস করে দরজা ফাঁক করে দেখি ইসলামী ছাত্র সংঘের নেসার মৌলানা প্রমুখ ১২৫ নাম্বার কক্ষের তিন চার জন আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। ক্ষীণ স্বরটি যে নীচ থেকে আসছে এবং তা বুলবুলের বুঝতে পেরে আমরা অনুসন্ধান করে এক তলার বাথ রুম থেকে তাকে উদ্ধার করি। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমরা তাকে দারওয়ানের জিম্মায় দিয়ে ফখরুল, কামরান এদের খবর দেই। গুরুতর আহত পাচপাত্তুর ইতিমধ্যে হাসপাতালে। পরবর্তীতে অতিরিক্ত মদ প্যান করার কারণে রক্তপাতে তার মৃত্যু হয়। খোকা অনবরত পিস্তল হাতে মটর সাইকেলে আমাদের হলের সামনে দিয়ে চক্কর দিচ্ছিল। আমার এন এস এফ বন্ধুরা, ফখরুল, কামরান এরা আমাকে তাদের সাথে থাকতে বলে এবং আমি তাই করি। উল্লেখ্য যে এরা সবাই পূর্ববর্তী সংখ্যায় উল্লেখিত দোলন পন্থী ব্রেন গ্রুপের সদস্য ছিল। ফখরুল স্বাধীনতার পর উপমন্ত্রী হয়েছিল; কামরান চার খলিফার একজন ছিল এবং পরবর্তীতে ৯/১১ মন্ত্রীসভায় পত্নী গীতিআরা সাফিয়া সহ উপদেষ্টা ও হয়েছিল। আমার আর এক সহপাঠী ইফতেখার ও এ পরিষদে ছিল ।
পাচপাত্তুর সহচর খোকা ও একটি নারীঘটিত খুনে খুন হয় বলে শুনেছি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের মালেক নামে একজনকে হত্যা করা হয়। তবে, স্বাধীনতার পর আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা তোলা নিয়ে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের সংখ্যা ৭৪ ও আহতের সংখ্যা দুই হাজারে পৌঁছে (দেখুন, আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭৪টি নরবলি,’ ফেসবুক)। লেখক উল্লেখ করেছেন যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতরা এ সংখ্যার বাইরে। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর নাজির আহমেদ ও মোতাহার হোসেন হত্যা যা হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে হয়েছিল তা তিনি উল্লেখ করেছেন ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার প্রজন্ম স্মৃতিচারণ করলে হত্যাকাণ্ড, এনএসএফের তাণ্ডবলীলা এ সব কথা আসবেই। তবে, দলটিতে ভাল এলিমেন্ট ও ছিল যা আমি কিছুটা হলে ও উল্লেখ করেছি। আগামী সংখ্যায় সে সময়ের বন্ধু বান্ধব নিয়ে স্মৃতিচারণ করার ইচ্ছে রইলো। প্রথম অংশটি পড়ে অনেকেই এ অনুরোধ রেখেছেন ।
Posted ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh