শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

‘হৃদয়ের জ্ঞান’ বনাম ‘জিহ্বার জ্ঞান’

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু :   |   বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২

‘হৃদয়ের জ্ঞান’ বনাম ‘জিহ্বার জ্ঞান’

পৃথিবী চলছে “জিহ্বার জ্ঞানে”, বাগাড়ম্বরে, যেখানে “হৃদয়ের জ্ঞানের” কোনো স্থান নেই। কথা ও কাজের মধ্যে অসামঞ্জস্য না করার জন্য আল্লাহ বলেছেন, তোমরা যা করো না তা বলো কেন?” ক’জন আল্লাহ’র এই কথা শোনে ও মানে! সাধারণ মানুষ তো শোনেই না, যারা নানা পর্যায়ে ক্ষমতাধর, তাদের কথা ও কাজের বৈপরীত্য পুরো সমাজকে প্রতারকের সমাজে পরিণত করে ফেলেছে, আমরা পদে পদে প্রতারকদের শিকারে পরিণত হই। আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, “ওরা মূর্খ, বধির ও অন্ধ। ওরা সত্যের পথে ফিরে আসবে না।”

সুফিবাদের আবির্ভাব হয়েছে মোটমুটি আব্বাসীয় বংশের শাসনামল থেকে এবং তখন থেকে সুফিরা জৌলুশ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত শাসক ও সমাজের প্রতিপত্তিধরদের হৃদয়ের জ্ঞানের পথে ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার হয়ে নিপীড়িত হয়েছেন। তারা সুফিবাদকে ‘কুফরি’, ‘খোদ্রাদ্রোহমূলক’, ‘ধর্মদ্রোহমূলক’, অভিধা দিয়ে সুফিদের বিতাড়ন করে শান্তিতে তাদের শাসন-শোষণ চালাতে চেষ্টা করেছেন।


এ প্রসঙ্গে বলতে এমন একজন সুফির অবতারণা করতে চাই, যার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। তিনি প্রথম যুগের সুফিদের অন্যতম আবু তালিব আল-মক্কী। ধারণা করা হয় যে তিনি নবম শতাব্দির কোনো এক সময়ে পারস্যের জিবাল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং মক্কায় বেড়ে ওঠেন ও আবু সাঈদ আল-আরাবি’র তত্ত্ববধানে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ৩৪১ হিজরিতে তিনি বসরায় যান পড়াশোনা করতে। স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশে বাগদাদ যাওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন সুফির সাহচর্যে আসেন ও মগ্ন ধ্যানীর জীবনযান শুরু করেন। তাঁর আহার্য ছিল সামান্য। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তিনি ব্যক্তিগত বিবেচনা ও যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন। আল-মক্কীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ “কুত আল-কুলুব ফি মুয়ামালাত আল-মাহবুব ওয়া ওয়াসফ তারিক আল-মুরিদ ইলা মাকাম আল-তাওহিদ” অর্থ্যাৎ ‘প্রিয়তমের সঙ্গে মেলামেশায় হৃদয়ের পুষ্টি এবং আল্লাহর একত্ব ঘোষণার পথের পদ্ধতিগত অনুসন্ধানের বিবরণী’।

এই জ্ঞান ‘মারিফা’ নামে পরিচিত, যা অর্জন করা সম্ভব অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক (বাতেনি ও জাহেরি) কাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হয়ে। আল-মক্কী কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে তাঁর অন্তর্নিহিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে ‘মারিফা’ হলো মুসলমানদের উপলব্ধ জ্ঞানের একমাত্র সত্য রূপ। তিনি “হৃদয়ের খোরাক’কে ব্যাখ্যা করেছেন নবী মুহাম্মদ সা: এর হাদিস দিয়ে: “জ্ঞান অন্বেষণ একটি কর্তব্য,” যা করতে হবে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মাধ্যমে, এবং স্বয়ং আল্লাহও বলেছেন, হৃদয়ের যে বিজ্ঞানের অতীন্দ্রিয় ও পরোক্ষ মূল্য রয়েছে। তিনি পরিপূর্ণভাবে নিষ্ঠাবান জীবনের উপাদানের ওপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়েও হৃদয়ের বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দান করেছেন এবং ‘জিহ্বার জ্ঞানকে বর্জন করেছেন।’ সেজন্য আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত জ্ঞান যেমনই হোক না কেন, তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। আল মক্কী বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর সময়ের মুসলিম শাসকরা ইসলামের সম্প্রসারণের নামে যে বিকাশ ঘটিয়ে চলেছিল তা ইসলামকে জাগতিক উন্নতির কাজে ব্যবহার করার মাধ্যমে এবং ‘জিহ্বার জ্ঞান’ চর্চার কারণে। আবু তালিব আল-মক্কীর গ্রন্থটিকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করে প্রায় দেড়শ’ বছর পর ইমাম আল-গাজ্জালি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “ইহিয়া উলুম আল-দ্বীন” বা “ইসলামী জ্ঞানের পুনর্জাগরণ” রচনা করেন।


ইসলামের প্রাথমিক যুগে মানুষের অভ্যন্তরীণ জীবন এবং সেই জীবনের বিজ্ঞানকে বাহ্যিক জীবনে প্রতিফলনের কথা বলেছেন আবু তালিব আল-মক্কী। ইমাম গাজ্জালি তাঁর নিজের আধ্যত্মিক অনুসন্ধানে আল-মক্কীর অবদানের কথা স্বীকার করেছেন “আল-মুনক্বিদ মিন আল-দালাল” বা ‘ভুলত্রুটি থেকে মুক্তি,’ যা ‘ইহিয়া উল উলুম’ এর অনুপ্রেরণা ছিল। ইসলামের সুফি ঐতিহ্য বর্ণনায় অনেক সময় “ফিকহ আল-ক্বলব’ বা ‘হৃদয়ের আইন’ এর কথা বলা হয়, যার ধারণা দিয়েছে আবু তালিব আল-মক্কী, যখন সুফিবাদ কেবল আবির্ভাবের পর্যায়ে ছিল এবং ‘হৃদয়ের জ্ঞান,’ বা ‘হৃদয়ের আইন’ ধরনের কথাবার্তাগুলোকে দৃশ্যত ধর্মদ্রোহমূলক মতবাদ বলে মনে করা হতো এবং এমন মতবাদের ধারক বা অনুগামীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে।

নবম শতাব্দিতে, অর্থ্যাৎ সুফিবাদের বিকাশের পর্যায়ে সুফিরা সীমাহীন বৈরিতার মুখে পড়েছেন, যা তাদের পূর্ববতী সূফি ধারা ব্যক্তিত্বদের সময়ে ছিল না। ইব্রাহিম আদহাম, হাসান আল-বসরী, রাবিয়া বসরীরা পবিত্র চিত্তে তাদের মতো করে আল্লাহর ধ্যান করেছেন। তারা তাদের বিশ্বাস বা চিন্তাকে অন্যের মাঝে ছড়ানোর প্রয়াস চালাননি। হয়তো সে কারণে কেউ তাদের বিরুদ্ধাচরণে অবতীর্ণ হয়নি। পরবর্তী সময়ে সুফিরা তাদের বিশ্বাসকে মানুষের সামনে এনেছেন এবং ‘জিহ্বার জ্ঞান’কে প্রতিস্থাপিত করতে বলেছেন ‘হৃদয়ের জ্ঞান’ দ্বারা। এখানেই বিপত্তি বেঁধেছে। ইসলামী শাসক, যারা তখন জৌলুস ও ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন, তাদের কাছে হৃদয়ের জ্ঞান মূল্যহীন ছিল এবং এ ধারণার প্রবক্তারাও তাদের দৃষ্টিতে ছিল প্রতিপক্ষ। আবু সুলায়মান আল-দারানি, যিনি সুফিদের কাছে ‘রায়হানুল কুলুব’ বা ‘হৃদয়ের মধুর পল্লব’ নামে প্রিয় ছিলেন, তাকে সিরিয়া থেকে বহিস্কার করা হয়, কারণ তিনি স্বপ্নে ফেরেশতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে দাবী করেছিলেন। একই ধরনের কারণে বায়েজিদ বোস্তামিকেও তার শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আল-হামজা আল বাগদাকে সমাজচ্যুত করা হযেছিল, কারণ তিনি মোরগের ডাকে ও বাতাসের প্রবাহের মধ্যে আল্লাহর উপস্থিতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। আবু সাঈদ আল-খারা, ‘সুফিবাদের কণ্ঠ’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন এবং সুফিবাদের মূল চেতনা “ফানা” (নির্বাণ) ও ‘বাকা’র (অস্তিত্ব) বিকাশ ঘটিয়েছেন, বাগদাদের উলামরা তাঁকে ইসলামে অবিশ্বাসী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। উলামাদের দৃষ্টিতে তাঁর ‘কিতাব আল-সির’কে (রহস্যের গ্রন্থ) খোদাদ্রোহমূলক। এভাবে আরো অনেক সুফি সাধককে বৈরিতা মুখোমুখি হয়ে জন্মস্থান ত্যাগ করতে হয়েছে।


আবু তালিব আল-মক্কী অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসেবে আল্লাহর একত্ব ও হৃদয়ের জ্ঞানের ওপর মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে বক্তৃতা করতেন। তিনি স্বাভাবিক খাদ্যের পরিবর্তে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জংলী গাছের লতাপাতা ও শিকড় (আল-হাশিস আল-মুবাহা) খেয়ে ক্ষুধা মেটাতেন এবং ধারণা করা হয় যে, এজন্য তাঁর ত্বক সবুজ বর্ণ ধারণ করেছিল। একবার তিনি বাগদাদে গেলে লোকজন তাঁর কথা শোনার জন্য ভিড় করে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য জনতার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়, কারণ তিনি বলেছিলেন, “লাইসা আল আল-মাখলুক্বিন আ’দার মিন আল-খালিক,” অর্থ্যাৎ “সৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার চেয়ে অধিক ক্ষতিকর আর কেউ নেই।” জনতা তাঁকে খোদাদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করে এবং তাঁকে বাগদাদ থেকে পালাতে হয়। আল-মক্কী এরপর কোনো জনসমাবেশে বক্তব্য দান থেকে বিরত থাকেন। তাঁর অনুসারীরা পরে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে আবু তালিব আল-মক্কীর কথার মর্ম ছিল, “একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ তার সৃষ্টির ক্ষতি সাধন করতে পারে না,” যার সহজ অর্থ হতে পারে, “আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে তাঁর সৃষ্টিকে ক্ষতি করতে সক্ষম নয়,” যা সুফি মতবাদের মূল দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ইসলামের মূল বিশ্বাসের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়, কারণ আল্লাহই সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত, “মুসাববিব আল-আসবা’ব”, ‘সকল কার্যকারণের পরিকল্পনাকারী।’

আল-মক্কী তাঁর ক্ষুধার্ত থাকা সম্পর্কে বলতেন, “ক্ষুধার মাঝেই রয়েছে জ্ঞান ও বিজ্ঞতা, আর ক্ষুধা উপশমের মাঝে থাকে অজ্ঞতা ও অবাধ্যতা।” এ ধরনের চরম কৃচ্ছসাধনকারী আরো সুফি ছিলেন, যাদের অন্যতম ‘সাহল আল-তুস্তারি, তাঁকে পুষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহ!” এরপর তাঁকে বলা হয়, “আমরা খাবার সম্পর্কে বলছি,” আবারও তাঁর উত্তর ছিল, “আল্লাহ!” প্রশ্নকর্তা বিরক্তির সাথে বলেন, “আমি আপনার কাছে দেহের পুষ্টি সম্পর্কে জানতে চাইছি (কু’ত আল-আজসা’ম আওয়াসববাব)। সাহল বুঝতে পারেন তাঁর কথা বোঝার মতো জ্ঞান প্রশ্নকর্তার নেই। অতএব তিনি প্রশ্নকর্তার পর্যায়ে নেমে আসেন এবং বলেন, “তুমি দেহের চিন্তা করে কি করবে? যিনি দেহ তৈরি করেছেন, তাঁর ওপর ছেড়ে দাও। তিনি চাইলে দেহ ধ্বংস করবেন, তিনি চাইলে দেহকে পুষ্টিতে পূর্ণ করবেন।

advertisement

Posted ২:৫৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২২

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(641 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.