ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | শনিবার, ০৭ আগস্ট ২০২১
১৯৬৪-১৯৬৮ এ চার বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম । লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে ও বেশ সক্রিয় ছিলাম। ঐতিহ্যবাহী সালিমুল্লাহ মুসলিম হলের (এসএমহল) আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ম্যাট্রিক, ইন্টামেডিয়েটে সারা পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র বোর্ড থেকে পাশ করা মেধাবী ছাত্ররা, বিশেষত যারা আর্টস এবং সোস্যাল স্যায়েন্স নিয়ে পড়ত তারাই এ হলে বেশী থাকত । বিজ্ঞানের ছাত্ররা ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এ দুটো’তে ভিড় জমাতো। অন্যথা যে হতোনা তা নয় । ইকবাল হলে আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এসব বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে যারা তারা ও থাকতো।
আম্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়টা তদানীন্তন পাকিস্তানের জন্য এবং ছাত্র রাজনীতির জন্য একটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব, ছয় দফা নিয়ে ধরপাকড় এ সবের সঘন রাজনৈতিক উপস্থিতি ছাত্র রাজনীতিকে দারু ভাবে প্রভাবিত করছিল স্বাভাবিকভাবেই । ১৯৬৬ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে একটি ভারসাম্য অবস্থা লক্ষ্য করা যায় । প্রগতিশীল ছাত্র দলগুলো, বিশেষত ছাত্র ইউনিয়ন আন্ত্রজাতিকতায় আবিষ্ট ছিল। চীন, রাশিয়ার প্রেম- প্রীতি, গুণগান আর আমেরিকা ও তার দোসরদের পিণ্ডি চটকানো এ দলটির নিত্যকার কর্ম প্রবাহের অন্যতম বিষয় ছিল। সভা-সমিতি, হরতাল, বিক্ষোভ সবকিছুতেই এ দলের নেতা, কর্মীরা এ ধারার আন্তর্জাতিক আদর্শের গুণগানে ব্যস্ত থাকত। মার্ক্সীয় দর্শন জানতে আমরা প্রচুর পড়াশোনা করতাম; মাও সেতুং আর লাল গ্রন্থ বা চটি বইটি গর্বের সাথে হাতে ধারণ করতাম। এ দলটিতে মেধাবী ছাত্রদের আধিক্য লক্ষণীয় ছিল । ছাত্র লীগ জাতিয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবই পরিচিত ছিল। ছয় দফা আন্দোলনে এ দলটি খুবই সোচ্চার ছিল । ইকবাল হলে দলটির অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত ছিল যদিও আমাদের সময় হোল ইউনিয়নে আসন ভাগাভাগি হতো ছাত্র ইউনিয়নের সাথে ।
তবে, এনএসএফ যেটির একমাত্র পরিচিতি ছিল সরকারের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা ছাত্র সংগঠন হিসেবে সেটি আমাদের সময় ইকবাল হলে কখনো সুবিধে করতে পারেনি । এস এম হলে অবশ্য দলটির বেশ শক্ত অবস্থান ছিল । প্রায় বছরই হল ইউনিয়নের নির্বাচনে কিছুকিছু আসন জিতে নিতো । সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে যে আসনটি অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট সেটি আমার ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের হাতছাড়া হতে দেখিনি। ঐতিহ্যগত ভাবে প্রথম ক্লাস পাওয়া কোন দলসচেতন তুখোড় ছাত্রকে এ আসনে মনোনয়ন দেয়া হতো । আমি যে বছর ভর্তি হই সে বছর আমার ভাই মোহাম্মাদ ফরাসউদ্দিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া কোন ইচ্ছুক প্রার্থী না থাকায় ভাইকে ঢাকা হল থেকে এস এম হলে নিয়ে আসা হয়েছিল আগেভাগেই। তার সাথে জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন ছাত্র শক্তির একজন । এ মুহূর্তে তার নামটি মনে পরছে না। তাছাড়া, জিশান ভাই ভিপি যে বছর সে বছর এনএসএফ থেকে জি এস ছিলে আনওয়ারুল রব চৌধুরি । এ রকম উদাহরন আরও আছে । এন এস এফ এর অবস্থা ভাল দেখলে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ, ছাত্র শক্তি এরা আঁতাত করে এক ফ্লাটফরম থেকে (খুব সম্ভবত সংহতি নামে) নির্বাচন করত । এ ক্ষেত্রে আসন ভাগাভাগি হতো তবে ভিপি পদটি ছাত্র ইউনিয়ন থেকেই হতেই আমি দেখেছি ।
সে সময়ের ছাত্র রাজনীতি নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হয় যে সৌজন্য বোধ আর সম্প্রীতির সম্পর্ক দৃশ্যমান ছিল, অন্তত ১৯৬৬ পর্যন্ত । হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন এবং প্রফেসর আবু মাহমুদ এনএসএফ ছাত্র নামধারী গুন্ডাদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর বিদ্যমান সৌহার্দে বেশ ভাটা পরে । এস এম হলে আমরা বেশী থের পেতাম কারণ শেষোক্ত ঘটনায় হলের দুজন প্রতিবাদী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী হায়াত হোসেন ও মোরশেদ কামালকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেছিল যদি ও তার মেয়াদ পরবর্তীতে হ্রাস করা হয়েছিল। আমার ভাইয়ের প্রসঙ্গ আগেই উত্থাপন করেছি। বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি কতটা গভীর ছিল তা তার বিরুদ্ধে ভি পি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিএ টি এম শামসুল হুদা’র সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতার কথা যারা জানেন তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন । তারা আজতক ও অতি ঘনিষ্ট বন্ধু।
ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা, পারস্পরিক সমালোচনা, বিবাদ এসব ছিল কিন্তু দলমত নির্বিশেষে প্রতিভাবানদের কদর ছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ফ্লাটফরম মিটিংয়ের রেওয়াজ ছিল । এসএম হলে এন এস এফ এর মিটিং হতো দ্বিতীয় ফ্লোরের করিডোরে । ছাত্র ইউনিয়নের হতো নিচ তলার করিডোরে।
এডভোকেট ইকবাল আনসারী, রাশেদ আহমেদ প্রমুখ যখন বক্তৃতা দিতেন আমরা আমাদের মিটিং থেকে কতিপয় ছুটে যেতাম চোস্ত ইংরেজিতে দেয়া বক্তৃতা শোনার জন্য । তেমনি ছাতরা ইউনিয়নের ফ্লাতফরমে ছুটে আসত উপর থেকে কিছু ছাত্র জাফর ভাই, জালাল ভাই, আকবর ভাই প্রমুখের বক্তৃতা শোনার জন্য । সম্মান বোধ, সহনশীলতা, পরস্পরের থেকে শেখার আগ্রহ- এসব আজকাল ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়না বল্লেই চলে ।
১৯৬৬-৬৮ সময়টা ছিল ছাত্র রাজনীতিতে যেমন জাতীয় রাজনীতিতে ও তেমনি ক্রান্তিকাল, পরিবর্তনের সময় । ৬৬ তে ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সিটিউটে ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনে ভাঙ্গনের সুস্পষ্ট আলামত দেখা যায় । আন্তর্জাতিক প্রগ্রেসিভে আদর্শ যা ছিল নীতি ভিত্তিক সে বাস্তবতা দলটিকে চীন ও রাশিয়া পন্থী শিবিরে বিভক্ত করে ফেলে । প্রো-পিকিং পন্থীরা মেনন গ্রুপ নামে পরিচয় ধারণ করে এবং প্রো -মস্কো অংশটি মোতিয়া গ্রুপ নামে ছাত্র রাজনীতির মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করে।
ছাত্র ইউনিয়নের অ্যান্টি- এস্টাব্লিশমেন্ট চরিত্র অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায় । এন এস এফ এ ও ভাঙ্গন শুরু হয় প্রায় একই সময়ে। আইয়ুব-মোনায়েম এর সমর্থন পুষ্ট দলটি শেষোক্ত জনের চেলা খসরু’র নির্দেশে জমির আলীর নেতৃত্বে এর ব্রেইন গ্রুপ খ্যাত অংশটি মাহবুবুল হক দোলন, কাইসার, আব্দুল আলিম বুলবুল, নাজিম কামরান প্রমুখদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায় । পূর্বেই বলেছি, ছাত্র লীগের অস্তিত্ব হলে তেমন দেখেছি বলে মণে হয় না । আব্দুল আজিজ বাগমার, খন্দকার মোশাররফ, আজাদ এরা তেমন সক্রিয় ছিলনা । শেষোক্ত জন আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে একটি চটি বই লিখেছিল সে সময়েই । এস এফ এ আসাফৌদুলাহ, মিজানুর রহমান শেলী, শাহেদ আলী Concept of Pakistan আদর্শে বিশ্বাস করতেন তবে হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে থাকতো । (চলবে)
Posted ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৭ আগস্ট ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh