আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | বৃহস্পতিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
নিউইয়র্কের হাডসন রিভারের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩১৫ মাইল হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গভীর নদী। উত্তর দিকে উৎপত্তিস্থল অ্যাডিরনডাক পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত নদীটি ওয়েস্ট পয়েন্টের কাছে ‘ওয়ার্ল্ডস এন্ড (পৃথিবীর শেষ প্রান্ত) নামে যে জায়গায় ২১৬ ফুট গভীর। স্টেটের রাজধানী অ্যালবেনি থেকে নিউইয়র্ক হারবারে নদী যেখানে আটলান্টিক মহাসাগরে মিশেছে, এই দৈর্ঘ পর্যন্ত গড় গভীরতা ৩২ ফুট। নিউইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় ৩২ মাইল দূরে মারিও ক্যুমো ব্রিজের উত্তরে উৎপত্তিস্থল থেকে খানিক উজানে নদী সবেচেয়ে বেশি প্রশস্ত, প্রায় সাড়ে তিন মাইল।
হাডসন রিভারের উভয় পাশে ১৭টি স্টেট পার্ক ছাড়াও শতাধিক ছোটবড় পার্ক রয়েছে, যেগুলোর দেখাশোনা করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ২৮ আগস্ট শনিবার আমাদের গন্তব্য ছিল আমার বাসস্থান জ্যামাইকা থেকে ৩০ মাইল দূরে সাড়ে ১২ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত ট্যারিটাউন সংলগ্ন হাডসন তীরের ‘সিনিক হাডসন রিভারওয়াক পার্ক’। কবি কাজী জহিরুল ইসলাম আমাদের সারথি। তিনি এই সিটিতে বাস করেন বলেই উইকএন্ডসে সিটির বাইরে দর্শনীয় স্থানগুলোতে একটু বেশিই যাওয়া হয়। আজ আমাদের সদস্য সংখ্যা ছিল মোটে সাতজন। কবি কাজী জহির, তার স্ত্রী মুক্তি জহির ও তাদের দুই কন্যা সারাফ ও নভো, অবিরাম কথক, অসহায়ের সহায়, অনলবর্ষী মানবাধিকার নেত্রী কাজী ফৌজিয়া, আমি ও আমার স্ত্রী কামরুন নাহার মণি। খাবারের আয়োজন সবার ওপর। আজকের খাবারের মধ্যে ছিল খিচুরি ও গরুর গোশত ভূনা, সালাদ, ফলমূল, মিষ্টি, বিস্কুট, শীতল পানীয় ও চা এবং চারজন তাম্বুল বিলাসীর প্রয়োজনীয় উপকরণ।
জ্যামাইকা থেকে যাত্রা করে পার্কে পৌঁছতে ৪৫ মিনিট সময় লেগেছে। খুব বড় পার্ক নয়, মাত্র সাড়ে পাঁচ একর এলাকাজুড়ে। কিন্তু সাজানো গোছানো। পার্ক ছাড়িয়ে নদী তীর ঘেঁষে পায়ে চলা পথের দু’পাশে সবই দৃষ্টিনন্দন। সর্বত্র বেঞ্চ বসানো, কেউ চাইলে সারাদিন নদীর দিকে তাকিয়ে অথবা নদীর অপর তীরের পার্বত্য শোভা দেখে দিন কাটাতে পারেন, কবিতা লিখতে পারেন ও ছবি আঁকতে পারেন। দেখা গেল অনেকে বড়শি ফেলে দাঁড়িয়ে বসে মাছ শিকার করছেন। রোদ না থাকলেও আবহাওয়া চমৎকার ছিল। পার্কের স্থানে স্থানে পিকনিকে আসা ছোট ছোট দল। অনেকে পায়ে চলা পথ দিয়ে হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে। নদীতীরের এই পথের দৈঘ্য ৪৩ মাইল, ১৪টি পৌর শহরকে স্পর্শ করেছে। যার যত ধৈর্য ও হাঁটার সামর্থ আছে তিনি ততদূর যেতে পারেন। আমরা ভালো একটি স্থান বেছে নিয়ে প্রথমেই খাবার সেরে নিলাম। উন্মুক্ত স্থানে খাবার আনন্দই আলাদা এবং এমন পরিবেশে যেকোনো খাদ্য উপাদেয় হয়ে ওঠে। নদীর দিক থেকে আসা নির্মল বাতাস ক্ষুধাও বাড়িয়ে দেয়।
একটু উজানেই হাডসনের উপর দীর্ঘ একটি ব্রীজ। ১৯৫৫ সালে এখানে যে ব্রীজ ছিল সেটি নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নরের নামে “ম্যালকম উইলসন ‘তাপান জি’ ব্রীজ”। ‘তাপান’ (ঞধঢ়ঢ়ধহ) ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রাচীন উপজাতির নাম, আর ‘জি’ (তবব) এর অর্থ ‘সী’ বা সমুদ্র। লোকজন এটিকে ‘তাপান জি ব্রীজ’ নামেই জানে। কিন্তু ব্রীজটি প্রয়োজনের তুলনায় অনুপযোগী হয়ে পড়ায় সেটির স্থলে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৩.১ মাইল দীর্ঘ নতুন যে ব্রীজটি নির্মাণ করা হয় সেটি চালু করা হয় ২০১৭ সালে এবং আগের নাম বাদ দিয়ে আরেক সাবেক গভর্নরের নামে “মারিও এম ক্যুমো ব্রীজ” নামকরণের প্রস্তাব করা হয়। নাম পরিবর্তনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি উঠলেও শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে সমঝোতার পর ২০১৮ সালে স্টেট আইনসভা ব্রীজের নাম ‘মারিও ক্যুমোর ব্রীজ’ করার প্রস্তাব পাশ করে। এ সময় মারিওর পুত্র এন্ড্রু ক্যুমো ছিলেন স্টেট গভর্নর। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে চলতি মাসেই গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোকে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক স্টেট আইনসভায় রিপাবলিকানরা প্রস্তাব এনেছে ‘মারিও এম ক্যুমো ব্রীজ” নাম পরিবর্তন করে সাবেক “তাপান জি ব্রীজ” নামকরণের।
বেচারা এন্ড্রু ক্যুমোর কথিত অপকর্মের খেসারত এখন তার পরলোকগত পিতাকেও দিতে হচ্ছে। যখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছিল তখন অনেক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে যে এন্ড্রু’র কারণে ক্যুমো পরিবারের দু’শ বছরের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত হয়েছে। ডজনখানে নারী এন্ড্রু ক্যুমোর বিরুদ্ধে তাদের সঙ্গে আপত্তিকর যৌন আচরণের অভিযোগ এনেছিলেন।
অভিযোগকারীরা কোনো আচরণকে বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিওনস্কির পর্যায়ে গিয়েছিল মর্মে অভিযোগ না করলেও এন্ড্রু তাদের সঙ্গে যা করেছিলেন তা আমেরিকান শালীনতা অনুযায়ী আপত্তিকর যৌন আচরণই ছিল। এন্ড্রু তদন্ত কমিটির শুনানিতে বলেছেন যে, তিনি যা করেছেন তা তিনি তার ব্যক্তিগত আচরিত অভ্যাস অনুযায়ীই করেছেন, যা দোষনীয় পর্যায়ে যেতে পারে বলে তিনি ভাবেননি। যেমন করমর্দনের সময় অভিযোগকারী নারীদের হাতে জোরে চাপ দেওয়া, কাঁধে বা কোমরে হাত রাখা এবং আলিঙ্গনের সময় গালে ঠোঁট স্পর্শ করা। কিন্তু সম্মতি ছাড়া এসব কর্ম আইনত শাস্তিযোগ্য, এবং এন্ড্রু ক্যুমো যথাবিহিত শাস্তি লাভ করেছেন।
আমেরিকান বলে নয়, সকল সংস্কৃতিতেই অভ্যাসের দাস এমন লোকজনের অস্তিত্ব রয়েছে। ২০১০ সালে নিউইয়র্কে এক বাংলাদেশী উচ্চশিক্ষিত আধুনিক আলেমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
আমার চেয়ে অন্তত ৭ বছরের বড়। একটি মসজিদে আমি কখনও জুমা নামাজ ও অন্য কোনো নামাজের সময় ওই মসজিদের কাছে থাকলেও সেখানে যেতাম। অনেক সময় ওই আলেম সাহেবকেও দেখতাম। নামাজের আগে পরে তিনি তার ঘনিষ্ট লোকদের আলিঙ্গন করে গালে চুম্বন করছেন। আরব জগতের পুরুষেরা তাই করে। তবে তা গালে গাল স্পর্শ করে ঠোঁটে চুম্বনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা অথবা না করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এই ভদ্রলোক রীতিমত গালে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুম্বন করেন। আমি বিষয়টি লক্ষ্য করার আগে দ্বিতীয় সাক্ষাতে তিনি আমার গালে চুম্বন করেন। এত ঘৃণা লাগে যে আমার গোসল করার ইচ্ছা হয়েছিল। একজন বৃদ্ধ পুরুষ কেন, মা মর্যাদার কেউ ছাড়া কোনো বৃদ্ধা নারীর চুম্বন নিতেও কি যুবক-বৃদ্ধ কারও ইচ্ছা হবে! এরপর থেকে তাকে দেখলে আমি করমর্দনের দূরত্ব থেকেও নিরাপদ দূরত্বে সরে থেকেছি এবং আলাপ প্রসঙ্গে তার কথা ওঠলে সকলকে সতর্ক করেছি তার কাছ থেকে দূরে থাকতে। একইভাবে এন্ড্রু ক্যুমোকে ধিক, শতধিক!
পার্কে বেড়াতে এসে ঘটনাগুলো নতুন করে মনে পড়লো। খাবার শেষে পান মুখে দিয়ে আমরা হাঁটতে বের হলাম। নদী তীর ধরে লাইট হাউজ পর্যন্ত হয়তো মাইল খানেক হবে। মেয়েরা পিছিয়ে পড়েছে। লাইট হাউজে পৌছে তাদের জন্য অপেক্ষা করে তারা এলে ফিরতি যাত্রায় আরও মাইল খানেক হেঁটে আগের জায়গায় ফিরলাম। ততক্ষণে সবাই ক্লান্ত। সবুজ ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে মেয়েরা একজন আরেকজনের গায়ে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে, যেন শৈশবে ফিরে গেছে। প্রকৃতিই বোধহয় মানুষকে শিশুতে পরিণত করে। ততক্ষণে পার্কটিতে আরও অনেক গ্রুপ ভিড় করেছে। খেলছে, মাছ ধরার চেষ্টা করছে, হাঁটছে। আমরা শুয়ে বসে থাকি, গান শুনি, নদীর ঢেউ ও পানকৌড়ির ডুব দেখি। পড়ন্ত বিকেলে নদীতে ঢেউ বাড়ছে। নদীর তীরে পানি আছড়ে পড়ছে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সাথে হালকা বাতাসে বেশ ঠান্ডা লাগছে। আমরা সাথে গরম কাপড় আনিনি। অতএব, আমরা সবাই ফিরে যেতে সম্মত হলাম।
Posted ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh