ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
এক
সমাজ স্থবির অবস্থায় কোনকালেই থাকে না। পরিবর্তন সকল ধরনের সমাজেই একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া । তবে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ধীর লয়ে আসবে, না সংস্কার নাকি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা আসবে নাকি যুগপৎ কালের ফ্রেমে মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় ধীর-দ্রুত তালবেতালে সম্পন্ন হতে থাকবে তা বহুবিদ কার্যকারণের উপর নির্ভর করে । সমাজের ক্ষেত্রে পরিবর্তন থেমে থাকেনা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও জনপদ থেকে মূলত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে আমেরিকায় বসতি স্থাপন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত তৈরি করার কাজ চলতে থাকার পড় থেকে নিরবধি পরিবর্তন চলছেই। প্রকৃতির সাথে কঠোর সংগ্রাম, আদিবাসীদের সাথে লড়াই, নিজেদের মধ্যেকার বিভিন্ন দল, উপদল, ইত্যাদি মোকাবেলা করে তবেই এ নতুন ভূমিতে আসন পাকাপোক্ত করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল । প্রথম পর্যায়ে অমানুষিক পরিশ্রম ও পরবর্তীতে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করে কৃষি, শিল্প, বিভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল অবকাঠামো এবং সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে তোলা হয় । আদিবাসীদের সাথে সংঘাত ও এদের নিয়ন্ত্রণের কাজ চলমান থাকা অবস্থায়ই কালোদের সাথে প্রলম্বিত সময়ের ব্যাপ্তিতে সংঘর্ষ শুরু হয় যা অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।
এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদ ও উদার গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দানকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একে তো বিশাল দেশ, তারপর সম্পদে ভরপুর দেশটি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার মাধ্যমকে । সমাজতন্ত্রকে যে কোন ভাবে রুখতে দেশটিতে পরিবর্তন মানেই সংস্কার, বিপ্লবের পথ ধরে নয়, শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনার পথ ধরে । তবে, সংঘাত, অসন্তোষ, হরতাল এমনতর সহিংসতা ও মাঝেমাঝে ঘটেছে এবং ঘটছে । এ সব নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াসে এ লেখা ।
দুই
সমাজ সংস্কার ধারনার উদ্ভব মূলত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্রেই সমাজ পরিবর্তনের আদর্শ হিসেবে, জীবন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নের উদ্দেশ্যে এ ধারনাটির সার্থক ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি । আজ থেকে তিন শত বৎসর পূর্বে ডরোথি ডিক্স বন্দীদের কারাবাস উন্নততর করার প্রচেষ্টা থেকে যে আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন তা পল্লবিত হয়ে, প্রস্ফুটিত হয়ে কালক্রমে সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত সমাজের প্রান্থদেশের অসহায় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কৌশল হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে । সরকারি, বেসরকারি, বিশেষত সেবাধর্মকে মিশন এবং ভিসন (Mission and Vision) মেনে নিয়ে নট-ফর-প্রফিট (Not-for-Profit) সংগঠনগুলো সংস্কার দৃষ্টিভঙ্গিকে পছন্দ করে তাদের সমাজ পরিবর্তন দর্শনে শামিল করে । মাদক আসক্তি রোধে টেম্পারেঞ্চ মুভমেন্ট, ১৮১৭ সালে থমাস গালুডেটের নেতৃত্বে বধিরদের জন্য ফ্রি স্কুল প্রতিষ্ঠা, ১৮৩০’র দিকে গ্রিডলে হু প্রতিষ্ঠিত অন্ধদের কর্মক্ষম করে তোলার জন্য কারিগরি শিক্ষা স্কুল স্থাপন এবং ১৮৫০’র সময়ে নিউ ইয়র্ক শহরে হোমলেস শিশু কিশোরদের জন্য চার্লস লোরিং ব্রেইস স্থাপিত সোসাইটি ইত্যাদি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের কতিপয় উদাহরণ । সমাজ পরিবর্তনে আজতক ও এ মানসিকতা ও দর্শন বলবৎ আছে যদিও ক্ষমতা দখলের জন্য রীতিসিদ্ধ গণতন্ত্রের পথ পরিহার বা আংশিক বিসর্জন দিয়ে যখন নেতারা অশুভ রাজনৈতিক তৎপরতায় মেতে উঠেন তখন এ পথ থেকে সরে গিয়ে দেশে ও সমাজে অসহনীয় বিপর্যয় শুরু হয় ।
সমাজ সংস্কারের উল্লেখযোগ্য একটি আন্দোলন ছিল ১৮৪০’র শতকে ওমেন্স রাইটস মভেমেন্ত জাড় সূত্রপাত ঘটেছিল নিউ ইয়র্কের সেনেকা ফলস এ অনুষ্ঠিত কনভেশনের মধ্য দিয়ে । এ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মহিলাদের সম্পত্তির মালিকানা লাভ, শিক্ষার সুযোগ চাকুরীর সুযোগ এবং পরবর্তীতে ভোটাধিকার আদায় সম্ভব হয় । এ সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্য, অন্যান্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এলিজাবেথ ক্যাডি স্টেনটন, এমা উইলার্ড, লুসি স্টোন , লুক্রেসিয়া মট এবং সুসান বি এন্থনি । এঁদের কেউই কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা পদ লাভের আশায় এ আন্দোলন করেন নি ।
আটারোশো’র প্রথম দিকে দাস প্রথা বা স্লেভারি’র বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তাও ছিল একটি সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তির আন্দোলন । কুয়াকারস (Quakers) সহ বিভিন্ন ধর্মীয় দলের স্লেভারি বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমে যে আন্দোলনের শুরু তাতে অনেককে আত্মাহুতি দিতে হহেছে । বেশুমার ত্যাগের বিনিময়ে দাস প্রথা রহিত করার ঘোষণা ১৮৬২ সালে রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ইমানসিপেশন ডিকলারেশনের (Emancipation Declaration) মাধ্যমে একটি সম্মানজনক পরিণতিতে পৌঁছে । স্লেভারি অবলুপ্তির ক্ষেত্রে এই যে মাইলফলক এর সাথে ১৮৬৬’র সিভিল অ্যাক্ট , ১৮৬৭’র পুনর্গঠন প্লান (Reconstruction Plan), ১৮৭৫ এ ংবমৎবমধঃরড়হ বেআইনি ঘোষণা, ইত্যাদি সবকটি পদক্ষেপই ছিল সমাজ সংস্কার মূলক এবং মানব কল্যাণ বিষয়ক । রাজনীতি অবশ্যই ছিল তবে মানুষের কল্যাণ সাধনের প্রয়োজন ও সদিচ্ছার কাছে ক্ষমতা দখল করার কুসারথ পরাভব মেনেছে ।
তিন
নতুন শতাব্দীর প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে বরত্মাঙ্কার যুক্তরাষ্ট্রে সোশাল ওয়েলফেয়ার ইস্যুগুলো ভিসন নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়েছিল । এফারমেটিভ অ্যাকশনের কতিপয় দিকের বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমে প্রচলিত সমাজ কল্যাণ সুবিধাগুলোর বিরুদ্ধে এ দেশে যে অশুভ রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট দনালদ ট্র্যাম্পের আমলে তা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিনেটে সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে ট্র্যাম্প ও তার সরকার অনেক সংস্কারই লণ্ডভণ্ড করে দিতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছিল । ক্যালিফোর্নিয়াতে উদ্ভূত প্রপোজিশন-২০৯, আল্বেনি থেকে উত্তিত রেন্ট কন্ট্রোলের উদ্যোগ, ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট নিয়ে ট্র্যাম্পের অশুভ তৎপরতা, মেডিকেয়ার, মেডিকেড এবং স্বাস্থ্য সেবা কঠিনতর করার উদ্যোগ, করোনা মোকাবেলা কড়া নিয়ে নাটক এবং করোনাকালীন স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে গড়িমসি, বিশেষজ্ঞদের মতের বিরদ্ধচারণ , জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ইস্যুগুলো অবহেলা, এমনকি প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে আসা ইত্যাদি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সুফলগুলোকে বিরাট ধাক্কার মধ্যে নিপতিত করেছিল । গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় আসায় ট্র্যাম্প আমলের সৃষ্ট অনেক সমস্যাকে মোকাবেলা করা হচ্ছে তবে কাজগুলো সহজভাবে করা যাচ্ছে না গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সঞ্জাত বোধগম্য কারণেই ।
Posted ২:৩২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh