ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২১
শিরোনামের ‘নিগৃহীত’ অংশটি জাতিসংঘের দেয়া একটি বিশেষণ । ২০১৩ সালে সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের বিশ্বে নিগৃহীত সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম বলে উল্লেখ্য করেছে । বার্মা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিলে ঘোষণা দিলে রুয়াইংগাদের (বার্মিজরা এ নামেই এদের অভিহিত করে) উপর নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে । নৃতাত্ত্বিক ভাবে ইন্দো-এরিয়ান গ্রুপের এ জাতিটি এখন রাষ্ট্রবিহীন ভাসমান একটি জনগোষ্ঠী ।
মূলত পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বহু শতাব্দী ধরে (৮ম শতাব্দীতেও বার্মাতে এরা বসবাস করত বলে জানা যায়) বসবাসরত রোহিঙ্গারা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশে অনুগৃহীত হয়ে বসবাস করছে । বার্মা বা বর্তমান মিয়ানমারে এক মিলিয়নের মতো রোহিঙ্গা কঠোর নিয়ন্ত্রণে প্রায় বন্দী অবস্থায় নিরন্তর কষ্টে দিন যাপন করছে। জোরপূর্বক এদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ করানো হয়। সামরিক জান্তা আর কট্টর পন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তাদের অনুসারীদের অত্যাচারে তারা নিত্যই নিগৃহীত । সুযোগ পেলেই তারা খুবই কাছের দেশ বাংলাদেশে চলে যায়। আধা সামরিক বার্মিজ সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ১৯৭৮ থেকে আজ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা যে প্রাণ হারিয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর । তবে, ১,৫৪৭,৭৭৮-২,০০০,০০০ মত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কোন কোন
দেশে আছে তার পরিসংখ্যান উইকিপিডিয়ার মতে নিম্নরূপ-
মায়ানমারঃ ১-১.৩ মিলিয়ন (২০১৬-১৭ নির্যাতনের পূর্বে)
পাকিস্তানঃ ২০০,০০০; থাইল্যান্ডঃ ১০০,০০০; মালয়েশিয়াঃ ৪০,০৭০;
ভারতঃ ৪০,০০০ : যুক্তরাষ্ট্র ১২,০০০; ইন্দোনেশিয়া ১১,৯৪১; নেপাল ২০০।
বাংলাদেশে প্রায় ৭-১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। তবে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী হওয়ার সম্ভাবনা কারণ অনেকেই চট্টগ্রামের ভাষার সাথে মিল থাকায় সেখানকার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায় । সস্তা শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিক, বিশেষত গৃহ কর্মচারী হিসেবে এরা কাজ পেয়ে যায় । আজকাল সরকারে ব্যবস্থাপনায় এদের শিবিরে রাখার কারণে এ প্রবণতা কিছুটা কমতির দিকে ।
তবে, মায়ানমার রক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া, আত্ত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় হলে নাফ নদী অতিক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে, দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে পালিয়ে আসার বিপত্তি মাথায় নিয়ে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামে আসছেই । অনেক মহলের মতে মোট রোহিঙ্গা সংখ্যার প্রায় অর্ধেকই এখন বাংলাদেশে।
রোসাং বা রোয়াং নামে পরিচিত এ জনগোষ্ঠী ঠিক কবে আরাকানে বসতি স্থাপন করে তা জানা না গেলো জনশ্রুতি আছে যে সপ্তম শতাব্দীতেই তা শুরু হয়েছে ।
বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজ ডুবে গেলে যাওয়া এবং বেঁচে গিয়ে তাদের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত “রহম” অভিব্যক্তি থেকে ‘রোহাং’ শব্দটির উৎপত্তি যার অপভ্রংশ ‘রোহিঙ্গা’ এমন ব্যাখ্যা বহুল প্রচলিত । তবে, ৮ম শতাব্দীতে আরব বনিকদের মাধ্যমে আরাকানে মুসলমানদের বসতি গড়ে উঠে এবং রোয়াংরা এদের সাথে মিলেমিশে যে সম্প্রদায় সৃষ্টি হয় তারাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত হয়। ১৪৩০-১৪৩৪ সময়ে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহের আনুকূল্য নারামেখেলা আরাকার সম্রাট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । জালাল উদ্দিন শাহ মৃত্যুবরণ করলে নারামেখলার বংশধরেরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল ।
তবে, মুসলিম রীতিনীতিতে তারা রাজ্য শাসন ও রাজসভা পরিচালনা করতেন। সভাসদ অনেকেই বাঙ্গালী মুসলমান ছিলেন । পারসি ভাষা বাংলার সাথে জনপ্রিয় ছিল। বেশ কয়েকটি অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সাথে মিয়ানমার সরকার নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার মর্যাদা লাভ করেছিল। তবে, বর্মিরা ১৭৮৫ সালে আরাকান দখল করলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইতিহাস বলে ১৭৯৯ সালে ৩৫ হাজারের বেশী মুসলমান বর্মিদের নির্যাতন ও গ্রেপ্তার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আরাকান থেকে সন্নিকটস্থ চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়।
ব্রিটিশরা বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করলে রোহিঙ্গাদের সেখানকার উর্বর ভূমি চাষাবাদের জন্য সমাদর করে অভয় দিয়ে আশ্রয় দেয়। বাঙ্গা ও আরাকানের মধ্যে সীমান্ত বলে কিছু ছিল। অবাধ যাতায়ত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তবে বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাতিন এবং মৌমেইন ইত্যাদি বড় বড় শর অ বাণিজ্য কেন্দ্রে মুসলমানদের সংখ্যা বেঁড়ে গেলে বর্মি এবং আরাকানের রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায় ব্রিটিশ নিথির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলমানদের প্রতি আক্রোশ, দাঙ্গা হামাঙ্গা ছড়িয়ে পরলে একটি ব্রিটিশ কমিশনের (জেমস ইস্টার তিন তুত কমিশন) বাংলা ও আরাকানের মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়। জাপানিদের আধিপত্য শুরু হলে বর্মিরা এঁদের পক্ষে এবং মুসলমানরা মিত্র শক্তি পক্ষে অবস্থান নেয় । (চলবে)
Posted ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh