আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : | বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩
কামরুল ইসলাম চৌধুরী আর নেই। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এক সপ্তাহ আগেই ভিডিও কলে কথা হয়েছে কামরুলের সঙ্গে। হাসপাতালের বেডে শোয়া, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ক্লান্ত, অবসন্ন। তার ক্ষীণ কণ্ঠের সঙ্গে আমি পরিচিত নই। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে জানতে চাইলেন, আমি কেমন আছি। তার জন্যে দোয়া করতে বলেন। তাকে বলি, চিন্তা করবেন না, সবসময় দোয়া করি। আল্লাহ ভরসা। আমরা খুব কাছের মানুষ ও আন্তরিক ছিলাম। দুই তিন মিনিটেই তার সঙ্গে কথা শেষ করি। ভাবির সঙ্গে কথা বলেন আমার স্ত্রী। এর দুদিন আগে তার ছেলে রাফা ম্যাসেঞ্জারে কল করেছিল। রাত বেশি ছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে রাফাকে কল ব্যাক করার পর সে কামরুলের অসুস্থতার শোচনীয় পর্যায় এবং চিকিৎসকেরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথা বলে দিয়েছেন বলে জানায়। সে কাঁদতে থাকে। সান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করি। ফোন রাখার পর রাফা টেক্সট মেসেজে ওর আব্বুর জন্যে দোয়া করতে বলে, যাতে তিনি শান্তিতে বিদায় নিতে পারেন।
কামরুলকে শেষবারের মতো দেখব না, একটু কথা বলতে পারব না, তা হতে পারে না। অস্থিরতা নিয়ে দুদিন পর রাফাকে কল করে জানতে চাই, ওর আব্বুর সঙ্গে কথা বলতে পারব কিনা। সে বাইরে ছিল, হাসপাতালে গিয়ে কল করবে বলে জানায়। ঘন্টা দুয়েক পর আমরা কথা বলি। বেদনা বোধের মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি পাই। ঘনিষ্ট কারো মৃত্যুর ঠিক আগে তার সঙ্গে কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করা কঠিন কাজ। আমার মায়ের মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলাম, কথা বলতে বলতে তিনি চলে যান। সাবেক মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে হাসপাতালে কথা বলে এসেছি তার মৃত্যুর এক দিন আগে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার সহপাঠি জিএম আলী হোসেন চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। খবর পেয়েই ওকে ফোন করি। সে শুধু বলতে পারে, ‘দোস্তো, দোয়া করো।’ সে আর ফিরে আসেনি। কামরুল ২০২০ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসেন হার্টের বাইপাস সার্জারি করাতে। তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছে। পরের বছর আবারও এসেছিলেন চেকআপ করাতে, তখনো কথা হয়েছে। কিন্তু চেকআপ করিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই দেশে চলে গেছেন বলে আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
কামরুলের সঙ্গে পরিচয় আশির দশকে। ঘনিষ্টতা বাড়ে আমি ১৯৯৮ সালে দৈনিক বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর। অফিস থেকে প্রেসক্লাব কাছে ছিল বলে তখন নিয়মিত ক্লাবে যেতাম। কামরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হতোই। তিনি আমাকে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামে (এফইজেবি) সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেন। আমি এফইজেবি’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হলেও প্রথম দিকের উর্ধতন নির্বাহীরা সবকিছু যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখতেন, তারা কে কখন এফইজেবি’র পক্ষ থেকে বিদেশ সফরে ব্যস্ত থাকতেন তা অন্য কোনো সদস্য জানতে পারত না। দেশে তারা কখনো এফইজেবির কোনো কর্মসূচির আয়োজন করেননি। বিরক্ত হয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।
এফইজেবি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ওই সময়ে এসকাপের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর এসএএমএস কিবরিয়া এবং এসকাপের উর্ধতন কর্মকর্তা কাজী ফরহাদ জালাল। জালাল সাহেব একবার ঢাকায় এসে এফইজেবি’র তখনকার সেক্রেটারি আহমেদ নূরে আলমকে বলেন যে, তিনি এফইজেবি সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে চান। বাধ্য হয়ে তিনি প্রেসক্লাবে একটি সভা ডাকেন। ফরহাদ জালালের বক্তব্যে জানা যায় ইতোমধ্যে আহমেদ নূরে আলম কোথায় কোথায় ঘুরে এসেছেন। সদস্যরা হতবাক হয়, প্রতিবাদ করে। আহমেদ নূরে আলম চুপসে যান। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করেন। পরে কাজী ফরহাদ জালাল কয়েকজনকে তার সঙ্গে সোনারগাঁও হোটেলে দেখা করতে বলেন। আমিও ছিলাম। তিনি এফইজেবি’কে পুনর্গঠন করার পরামর্শ দেন এবং জবাবহিদিতা নিশ্চিত করতে বলেন। কামরুলের পীড়াপীড়িতে আমি আবার সক্রিয়ভাবে এফইজেবি’র সকল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। তিনি চেয়ারম্যান। আমাকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে চান এবং আমি পর পর তিন টার্ম অর্থ্যাৎ ছয় বছর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
এফইজেবি’কে তিনি ব্যাপকভিত্তিক এক সংগঠনে পরিণত করেন। প্রতিটি সংবাদপত্র থেকে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেন। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশংসনীয়। সকল সমালোচনা, বিতর্ক হাসিমুখে সামাল দিতে অদ্বিতীয় ছিলেন। বছরজুড়ে দেশে বিদেশে এফইজেবি’র কর্মসূচি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এ কারণে তিনি অনেকের ইর্ষার পাত্রও ছিলেন। এফইজেবি অল্পদিনের মধ্যে এফইজেবিকে তিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, পরিবেশবাদী সাংবাদিকদের আঞ্চলিক সংগঠনের রূপ দিয়েছিলেন। ঢাকায় এফইজেবি’র অনেক সেমিনার, ওয়ার্কশপ হয়েছে এবং এসব কর্মসূচিতে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, কানাডা, ফিজি, চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের সাংবাদিক প্রতিনিধিরা পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছে। বিদেশি প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে অবস্থান ও তাদের বিনোদন, আপ্যায়নে যাতে কোনো ত্রুটি না হয়, সেজন্য তিনি মোটামুটি দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন। কাউকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেননি। এফইজেবি’র প্রতিনিধিদের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাঠানোর ক্ষেত্রেও তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আমি নিজেও বেশ ক’টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিতে সুইডেন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভারত সফর করে সমৃদ্ধ হয়েছি। তার দ্বারা নানাভাবে উপকৃত হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক।
শুধু এফইজেবি’র দায়িত্বশীল হিসেবেই যে তার সঙ্গে এক হয়ে কাজ করেছি, তা নয়, ২০০১ সালে বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেলে আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করি এবং কামরুলের পেশাগত সহকর্মীতে পরিণত হই। এক সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এফইজেবি’র কাজ পরিচালনা বেশ সহজ হয়ে উঠেছিল। বাসস’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে আমানউল্লাহ কবীরের নিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন গাজীউল হাসান খান। তিনি বার্তা প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন আনেন। কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন চিফ রিপোর্টারের। আমাকে বার্তা সম্পাদক থেকে পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ করেন উপ-প্রধান বার্তা সম্পাদক। প্রধান বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন জহুরুল আলমকে। ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের পদ শূন্য ছিল। জগলুল আহমেদ চৌধুরী আশা করতেন তাকে এ পদটি দেওয়া হবে। হামিদুজ্জামান রবি ভাইও আশা করতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি রবি ভাইকেই দায়িত্বটি দেন।
এসময় কামরুল ইসলাম চৌধুরীর বিদেশ ভ্রমণ প্রায় ঘন ঘন ছিল। ফলে তার পক্ষে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছিল না। গাজীউল হাসান খান বিরক্ত হয়ে উঠেন। আমাকে ডেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাপ দেন। আমি তাকে কামরুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলে তাকে নিবৃত করতে চেষ্টা করি।
কিন্তু কামরুলের পরবর্তী বিদেশ সফরের সময় আমাকে কিছু না জানিয়েই চিফ রিপোর্টারের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করেন এবং কামরুলকে চিফ রিপোর্টারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার চিঠি তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন। আমি বিব্রত বোধ করি। কামরুল দেশে নেই, চিঠি পড়বে ভাবির হাতে, তিনি কী ভাববেন! কামরুল ফিরে এলে আমি তাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি। তিনি হাসিমুখে আমাকে অভিনন্দন জানান।
২০১০ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। মাঝে মাঝে ফোনে কামরুলের সঙ্গে কথা হয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি তার ছেলে রাফাকে নিয়ে নিউইয়র্কে আসেন। তার আগমণ সম্পর্কে আমি জানতাম না। এক প্রোগ্রামকে হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের আরেক সহকর্মী বাসস এর সাবেক রিপোর্টার সৈয়দ ওয়ালিউল আলমের বাসায় উঠেছিলেন। আমি তাকে বলি আমি এখানে থাকতে আপনি ওয়ালি’র বাসায় উঠবেন কেন? তাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। অবশিষ্ট দিনগুলোতে আমার সঙ্গেই ছিলেন এবং আমি তাকে আমার সীমিত সাধ্যে সিটির বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেছি। এরপর তিনি রাফাকে নিয়ে আসেন সম্ভবত ২০১৬ সালে। তার ছেলে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। পাশের স্টেট পেনসিলভেনিয়ায় অবস্থিত রাফার বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব নিউইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় আড়াইশো মাইল।
পরবর্তী বছরগুলোতে রাফা ঢাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বা ছুটিতে দেশে যাওয়ার সময় আমার বাসায় কয়েকদিনের জন্যে যাত্রাবিরতি করলে কামরুলের সঙ্গে আমার এবং ভাবির সঙ্গে আমার স্ত্রীর কথা হতো। কামরুল আর নিউইয়র্কে আসেনি। আমার সঙ্গে ২০১৬ সালের পর আর দেখাও হয়নি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাফা হঠাৎ করেই একদিন বাসায় এলো। আসার আগে ফোনও করেনি। ছুটির দিন ছিল বলে বাসায়ই ছিলাম। নিউইয়র্কে কী একটা প্রোগ্রামে এসেছে সে। ওর আম্মা আমার স্ত্রীর জন্যে একটা গিফট পাঠিয়েছে, সেটি দিতেই সে ম্যানহাটান থেকে কষ্ট করে জ্যামাইকা পর্যন্ত এসেছে। ওর আব্বার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাই। দু’মাস আগে কামরুল বাসস থেকে অবসর নিয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা স্ট্যাবল বলে জানালো রাফা। রাফার তাড়া ছিল। চা খেয়েই চলে যায়। মার্চ-এপ্রিলেই যে কামরুলের স্বাস্থ্যের এতটা অবনতি হয়েছে তা জানতে পারিনি।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী আমার চেয়ে বয়সে পাঁচ ছয় বছরের ছোটো হলেও আমি আমার আচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তাকে ‘কামরুল ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। তিনি আমার জ্যেষ্ঠতার যথাযথ সম্মান দিয়েছেন। তিনি এফইজেবি’র চেয়ারম্যান হওয়া সত্বেও মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ওপর জোর খাটিয়ে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে দিয়েছেন। নেপালসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করার দায়িত্ব পালনে বাধ্য করেছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
কামরুলের সঙ্গে পৃথিবীতে আর কখনো দেখা হবে না, এই দু:খ নিয়ে আমাকে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটাতে হবে। আশা করি পরকালে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদৌসে স্থান দিন।
Posted ১২:৪৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh