মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্তি করেন। দাসপ্রথার পক্ষে বিপক্ষে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। সেই যুদ্ধে আট হাজার মানুষ মারা যায়। সবাই ভেবে ছিলেন তিনি আর পারবেন না হেরে যাবেন। কিন্তু একমাত্র প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পরিস্থিতি সামলাতে থাকেন। দেশের শান্তি কামনায় নিহতদের স্মরণ সভায় দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ দিলেন। পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল” তাঁর সেই ভাষণ আজো বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের কাছে স্মরণীয় এবং অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে। সেই আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে আমেরিকাকে রক্ষা করেন। তিনি আমেরিকার গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ইতিহাস রচনা করে গেছেন। অথচ তাঁর দলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে বিভক্তির দেয়াল তৈরি করে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উভয়ই ৭ কোটির বেশি ভোট পেয়েছেন। এতে দেশের জনগণের মধ্যে চরম বিভক্তির প্রকাশ ঘটেছে। মার্কিনিরা চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেন, ট্রাম্প যেভাবে বিভক্তির জাল বুনে গেছেন, তা জনগণ থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এর জন্য আরও কয়েকটি নির্বাচনের দরকার হবে। তা না হলে দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর গণতন্ত্রের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশ বলেন, বারাক ওবামা।
৬ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বানে ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের সামনে হাজার হাজার সমর্থকের ভিড় জমে। ট্রাম্প সেখানে ভাষণ দিয়ে তাঁদের উস্কে দেন। তাঁর উস্কানিতে কংগ্রেসের ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকেরা নজির বিহীন তান্ডব চালায়। যা আমেরিকার ২০০ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এ ন্যাক্কার জনক ঘটনায় হতবাক হয়েছে দেশের নাগরিক ও বিশ্ব। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার গর্ব ও গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। যা ক্ষমার অযোগ্য। পার্লামেন্ট ভবনের ভিতরে গুলিতে এক নারী সহ ৪ জন নিহত ও পরে একজন পুলিশও প্রাণ হারান। এতে শতাধিক দাঙ্গাবাজ গ্রেফতার হয়। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির দপ্তর সহ বিভিন্ন অফিসে ব্যাপক ভাংচুর চালায় তারা। ডিসিতে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ট্রাম্পের উপ-নিরাপত্তা উপদেস্টা সহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট জো বাইডেনের জয় অনুমোদন দিতে কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশনে ইলেক্টরাল কলেজের ভোট গননাকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প সমর্থকরা এ ন্যাক্কার জনক ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় ট্রাম্প নিজেই নিজেকে ডিসকোয়ালিফাইড প্রমাণ করেছেন।
এ দেশে যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, তারা প্রাধান্য দিয়েছেন দলের চেয়ে দেশকে এবং জাতিকে। আর ট্রাম্প প্রাধান্য দিয়েছেন তার সমর্থকদের দেশকে নয়। ফলে তার সমর্থকরা বেপোরোয়া ও উচ্ছৃক্ষল হয়ে উঠেছে। তাদের ভিতরে এক প্রকার বিদ্রোহী বিদ্রোহী ভাব লক্ষ করা গেছে। এ দেশের জনগণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, হায় আমেরিকা কোথায় চলে যাচ্ছে। দেশের মানুষ মনে করেছে বাইডেন যদি প্রেসিডেন্ট হন তাঁর দ্বারা দেশ পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। তাই তাঁর পক্ষে দেশের জনগণ ঝাপিয়ে পড়েছে।
আজ বাইডেনের এ বিজয় তাঁর একার নয়, তাঁর বিজয় জনগণের বিজয়। বাইডেনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বিভাজন থেকে মুক্তি পাবে। এ আশাই তারা করছেন। ট্রাম্পের আচরণে উৎসাহ পেয়েছে বিশ্বের স্বৈরশাসকরা। গোটা বিশ্বকে গণতন্ত্রের পথে আসার ডাক দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট। উন্নত গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে সে অধিকার ছিল দেশটির। কিন্তু সব কিছু গোলমাল করে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্টের কর্মকান্ড দেখে স্বৈরশাসকরা উৎসাহই পেয়েছে বৈকি। ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায় ট্রাম্প কর্তৃক মেনে না নেয়া, রায় বানচাল করতে নানা অপকৌশল, মামলা মকর্দমা তার সমর্থকদের উসকে দেয়া, ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলার ঘটনা, যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতকে একটা বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে ছিলেন। মার্কিন সমাজে বড় ধরনের বিভক্তি তৈরি করে দিয়েছেন। এর থেকে কোন দিন মুক্তি পাবে দেশ তা বলা যায় না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে হেরেও তিনি আমেরিকার ইতিহাসে যে কোন ক্ষমতাশীন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। করোনা স্বাস্থ্য সংকট ও এত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরেও তিনি এত বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে আমেরিকার ইতিহাসে এমন একজন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্যেও কিভাবে তার এত সমর্থন ধরে রাখলেন। তা ভেবে অবাক হই। করোনা মহামারী না ঘটলে তিনি নির্ঘাত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন সন্দেহ নেই। তখন আমেরিকার অবস্থা কি হতো, তা পরের কথা তবে তিনি যে আমেরিকার বড় ধরনের সর্বনাশ করে দিতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, ইরান কে কেন্দ্র করে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতেন হয়তো।
ট্রাম্প জনসভায় নিজে মাস্ক পরতেন না। তাঁর সমর্থকরাও মাস্ক ব্যবহার করতো না। করোনা মাস্ক নিয়ে সর্বদা তিরস্কার করতেন। তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য গর্ভনর মেয়রদেরকে প্রেসার দিতেন। মহামারীতে সব কিছু বন্ধ করায় আমেরিকার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ট্রাম্প ডেমোক্রেটদের দোষারোপ করতেন। করোনা মহামারীকে পাত্তা দেননি বলে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। তা সত্যেও তিনি কি করে এত সমর্থন পেলেন? ট্রাম্প সব কিছুতেই শত্রুতার মাঠ উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মানুষকে বিভক্তি করে দিয়েছিলেন তাঁর বক্তৃতার মঞ্চে। জর্জিয়ার নির্বাচনী কর্মকর্তার নাম গ্যাব্রিয়েল স্টালিং, তিনিও একজন রিপাবলিকান। জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেটের ভোট ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহিংসতার প্ররোচনা দিয়ে আসছিলেন। তার জেরে কোন সহিংসতা হলে তার দায় ট্রাম্পকে নিতে হবে। অনেক হয়েছে, এখন তাকে থামাতে হবে। আমাদের এগুলো বন্ধ করা দরকার। দেশের ক্ষতি হতে দেয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটনি জেনারেল উইলিয়াম বার, তিনিও তার দলের। তিনি বলেছেন ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে জালিয়াতির যে অভিযোগ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করেছেন তার সমর্থনে কোন প্রমাণ বিচার বিভাগ খুঁজে পাননি। তিনিও পদত্যাগ করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় থাকলে আমেরিকাকে দুই টুকরো করে দিতেন। জনগণ তাঁদের প্রিয় দেশকে রক্ষা করেছেন। ভোটের ফলাফল আমেরিকার বিভক্তির দিকে ইংগিত করে। এই নির্বাচনে আমেরিকার ভোটারদের যে বিভক্তি তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পের জনসভায় তাঁর উস্কানিমূলক বক্ত্যব ও বেপরোয়া আচরণ রাজনৈতিক ভাবে লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। এক রকম দুই টুকরো করে দিয়ে যাচ্ছিলেন আমেরিকাকে। সেই এজেন্ডা নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন। বিশাল সংখ্যক সমর্থন নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন যা আমেরিকার জন্য বিরাট ক্ষতির কারন হয়ে উঠেছিলো। এজন্যই তাঁর বিচার হওয়া দরকার।
আমেরিকার জন্য এ এক কঠিন পরীক্ষা। তা না হলে কি ট্রাম্পের মতো একজন বর্নবাদি লোক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন? তা না হলে এটা কি প্রমাণ করে না, আমেরিকায় আজ বর্নবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর কারিগর হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এখন তাদের আইকন। যেখানে জো বাইডেনের বিপুল বিজয় হবার কথা, সেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ট্রাম্পকে পরাস্ত করতে হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করছেন ট্রাম্প। যে দেশ গণতন্ত্রের জন্য আশীর্বাদের, সাধারন মানুষ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করার সুযোগ আছে, গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সে দেশে ট্রাম্পের মতো লোক কিভাবে প্রেসিডেন্ট হয় তা ভাবতে অবাক লাগে। ট্রাম্প ১৫ বছর ট্যাক্স দেন না। বহু কেলেঙ্কারির যিনি হোতা, তিনি বিশ্বের নেতা হন কিভাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা যাই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট পদের লোভ ট্রাম্প ছাড়তে পারছিলেন না। নির্বাচনে হেরে গিয়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থাকেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কোন কিছুই তিনি মানছেন না। তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। সব কিছুই তিনি অস্বীকার করেছেন। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। তার দলের সমর্থকদের উসকে দিয়েছেন আন্দোলন করতে। চেষ্টার কমতি করেননি কোন ক্ষেত্রে। আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, দেশের নিরপেক্ষ প্রশাসন তা হতে দেননি।
জনগণের রায়ে বিজিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ক্ষমতায় বসাতে এগিয়ে এসেছেন। এর জন্য প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট বাইডেনকে কোন প্রকার আন্দোলন বা প্রতিবাদ করতে হলো না। স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাই তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেন বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে। এটিই হলো আমেরিকা। ট্রাম্পের এত কিছুর পড়েও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় থেকেও কিছু করতে পারেন নি। আমেরিকার বিচার ব্যবস্থা কতো যে সচ্ছ্য এ থেকেই তা বুঝা যায়। এ দেশের আইন এবং এর প্রয়োগ সবার জন্য সমান। আর তৃতীয় বিশ্বে তথা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের দাড়াবার জায়গাটুকুও পর্যন্ত নেই। শাসকদের কাছে মানুষের শেষ ভরসাটুকুও থাকে না। প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। লোক দেখানো ভোটের কাজকাম দেখান। অনর্থক কোটি টাকা ধ্বংস করেন।
ক্ষমতার কাছে লোকজন কেউ কিছু বলতে পারে না। এভাবেই তাঁরা ক্ষমতায় আছেন। আর এতো আমেরিকা। যেখানে প্রতি পদে হিসাব দেবার ব্যবস্থা কোন কারচুপি করতে পারবেন না। দীর্ঘ ৪৮ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন। শেষ জীবনে এসে তাঁর চাওয়া পাওয়া কিছু নেই একমাত্র মানুষের কল্যাণ ছাড়া। তিনিই আমেরিকার আশার আলো দেখাবেন বলে সবার আশা। আমেরিকার মঙ্গল কামনা করি আমরা।
Posted ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh