ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট ২০২১
(৪র্থ পর্ব) : গত সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম যে আমার বেশ ক’জন সহপাঠী পরলোকগমন করেছে। আমার দেয়া তালিকায় অন্তত দু’জনের নাম বাদ পরেছে। তারা হলো আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও আবুল কালাম আজাদ। মাখনের নাম ও খ্যাতি ষাট আর সত্তর দশকের বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া’র পুনিয়ট গ্রামের এই সুসন্তানকে আমি ছাত্র জীবনে একজন ভাল এবং বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সুবাদে আমাকে ‘বিয়াই, বলে ডাকত।
আর্থিকভাবে খুব একটা স্বচ্ছল না হওয়ার কারণে ছাত্র জীবনেই চাকুরী করত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। রাতের শিফটে কাজ শেষ করে পলাশী থেকে প্রায়ই এস এম হলে আসত। দু’বন্ধু প্রায়ই হলের ক্যান্টিনে এক সাথে সকালের নাশতা সারতাম। আনেক স্মৃতি বিজড়িত সম্পর্ক আমাদের। মুক্তি যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমি কাউকে না জানিয়ে আগরতলা যাই ধর্মঘর বর্ডার হয়ে। সহপাঠী মর্তূজ আলী’র বড় ভাই সাহায্য করেছিলেন। সেখানে গিয়ে বাবার বন্ধু মোক্তার হিরেন্দ্র চৌধুরীর বাসায় আশ্রয় নেই। পরের দিন ছড়ানো ছিটানো ক্যাম্পে গেলে মাখনের সাক্ষাত পাই। খুব অবাক হয়ে আমাকে আড়ালে নিয়ে বলে আমি যাতে কালবিলম্ব না করে বাড়ী চলে যাই। আমার ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ পরিচিতি আমার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাছাড়া, আমার ভাই সিএসপি এবং তখন ও পোস্টিং করাচীতে তার ও অসুবিধে হতে পারে।
মাখনের যুক্তির সারবত্তা ফেলে দেওয়ার মত ছিল না। পরের দিনই ১০ মাইল দূরে আমার গ্রামের বাড়ী ফিরে যাই। তার সাথে স্বাধীনতার পর মাত্র দুবার দেখা হয়েছিল। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে। একদিন রাত প্রায় দশটার দিকে সে চার পাঁচ জন বন্ধু নিয়ে আমাদের বাড়ীতে হাজির। এসেই খেতে চেয়েছিল। আমার বড় ভাই ডাকাডাকি শুনে বের হয়ে তাড়াতাড়ি মা ও ভাবীকে ডেকে তুললেন। ভাগ্যক্রমে কিছু ভাত ও তরকারি (শিংমাছ সিম দিয়ে রান্না করা) ছিল। গোগ্রাসে গিলে ট্রেনের শব্দ শুনতে পেয়ে ভোঁ দৌড়। শাহাজিবাজার স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ী কাছের ছাতিয়াইন স্টেশনে গিয়ে ট্রেন তারা ঠিকই পেয়েছিল। ঘটনা ছিল আমাদের বাড়ী থেকে তিন মাইল পশ্চিমে এক বিখ্যাত গ্রামে বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে খাওয়া দিতে দেরী হওয়ায় ট্রেন মিস করবে এ আশংকায় না খেয়েই চলে আসা।
তার সাথে আর ও অনেক স্মৃতি আছে যা লিখতে গেলে লেখাটির কলেবর বেড়ে যাবে। দ্বিতীয় যে বন্ধুটির কথা উল্লেখ করেছি -আজাদ আর আমি একই হলে থাকতাম। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিল । প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিল। ছাত্র অবস্থায়ই আঞ্চলিক বৈষম্যের উপর একটি চটি বই লিখেছিল। খুব পরিশ্রমী আজাদ ছাত্র পড়িয়ে পড়াশুনার খরচ নির্বাহ করতো। একটি লাল রঙের মটর সাইকেল নিয়ে ছাত্রদের বাসায় বাসায় যেত। কি কারণে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীটা চলে গিয়েছিল। আল্লাহ মাখন ও আজাদকে বেহেশত নসিব করুন দোয়া করি।
আমাদের ব্যাচে আনোয়ার তুখোড় ছাত্র ছিল অনার্সে প্রথম হয়েছিল, আমি হয়েছিলাম দ্বিতীয়। প্রথম শ্রেণী ১৯৬৭ এ কেউই পায়নি। মাস্টার্স এ আনোয়ার তার দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিল। আমি তৃতীয় স্থানে চলে যাই । প্রথম শ্রেণী পেয়েছিল প্রিলিমিনারি থেকে আসা আমার মিতা আশরাফ। আনোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জীবন আই বি এ’তে শুরু করে বর্তমানে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Northern University) উপাচার্য । প্রচুর পাবলিকেশন আছে। আমি পল্লী উন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পালাক্রমে চাকুরী করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি (১৯৯৫ সাল থেকে) । পরিবার-পরিজন (নাতী চারজন ও একটিমাত্র নাতীন নিয়ে কালাতিপাতের সাথে সাথে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয় লিখে যাচ্ছি অনেক দিন যাবত । মাঝেমধ্যে ইনডিপেনডেন্ট কন্সালটেন্ট হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছি মূলত প্রোগ্রাম ডিজাইন এবং ফ্যামিলি ও কমুনিটি পার্টনারশিপ বিষয়ে । কেন্দ্রীয় সরকারের হেড স্টার্ট প্রোগ্রামেই বেশীর ভাগ কাজ করেছি । অসুখ বিসুখের জন্য কাজটি চালিয়ে যেতে পারছি না অনেক দিন যাবত । নাতী -নাতনী, পত্রিকার জন্য লেখা, কবিতা এসব নিয়ে দিন ভালই কাটছে বলতেই হয়।
আমাদের আরেক সহপাঠী কাজী সদরুল হক ও কানাডার টরন্টোতে একটা বড় বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে অনেক বছর কাজ করে বর্তমানে নাতী – নাতনী নিয়ে মহা আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। বাদল (দেওয়ান শামসুল আরেফীন)বছর দু’য়েক হলো লেখালেখির জগত থেকে বেশ ঘটা করে বিদায় নিয়েছে। অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ, ২০১৯ ছিল তার আনুষ্ঠানিক বিদায়ের দিন। অনেকের সাথে আমি ও উপস্থিত ছিলাম। আরেফিনের ১০-১২ টি বই ডিসপ্লেতে ছিল। যারা তার পাঠক সমাদৃত বই পেতে আগ্রহী তারা আমাজন, রকমারি বা সরাসরি লেখকের কাছ থেকে জোগাড় করতে পারেন। তার ই-মেইল ঠিকানা হলো [email protected]। আমি যেক’টি বই পরেছি সেগুলোতে একটি বিশেষ আদর্শিক দৃষ্টিকোণের সাক্ষাত পেয়েছি । রাশেদ খান মেনন বলেন, “আরেফিন এর লেখা তথ্যসমৃদ্ধ কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু তাঁর চেয়ে গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসৃমৃদ্ধ … বরং একজন শ্রেণী সচেতন মানুষের। তার লেখার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-তার যুদ্ধচক্রান্ত, মানবতাবিরুধি অপরাধ অপরাধ সম্পর্কে তার অবস্থানটাও খোলাখুলিভাবে বেরিয়ে আসে”। দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কের সংবাদ পত্রে কলাম লিখতেন তাই বুঝি রকমারি বিষয়ে তার বিচরণ ছিল। এ জায়গাটায় আমাদের দু’জনের মিল আছে । আমার শ’দেড়েক লেখা ও হরেক রকম বিষয় নিয়ে যদিও জলবায়ু পরিবর্তন, সমসাময়িক রাজনীতি (বাংলাদেশের উপর নেই বললেই চলে), বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়ন, সামাজিক ইস্যু, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে।
আমাদের আর এক সহপাঠী ড. শফিকুর রহমান সাউথ ক্যারোলিনা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিজম এবং কমুনিকেশন প্রোগ্রাম এবং ইংলিশ ও মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগের প্রফেসর। তিনি সাফল্যের সাথে, সুনামের সাথের এতগুলো কর্মসূচীর সমন্বয় করে যাচ্ছেন । একাডেমিক ও বিবিধ বিষয়ে নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘদিনের । তার প্রকাশনার সাথে তেমন পরিচয় না থাকায় আর বেশী আলোকপাত করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। একই কথা ড. আদিত্য, ড.সদরুলের বেলায় ও প্রযোজ্য।
লেখাটিতে অনেক ভুলভ্রান্তি থাকবে। লেখাটি দীর্ঘসময়, সেই ১৯৯৪ থেকে ২০২১ সময়ের পরিক্রমা নিয়ে রচনা করতে গিয়ে অনেক কিছু স্মৃতির অগোচরে রয়ে গেছে, ভুলে ও গেছি অনেক ঘটনা , অনেকের অর্জন ইত্যাদি। আশা করি বন্ধুরা ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে; প্রয়োজনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে যাতে শোধরানো , সংযোজন সম্ভব হয়। আমাকে এ ঠিকানায় [email protected] যোগাযোগ করা যাবে। (সমাপ্ত)
Posted ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh