ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মানব সমাজের বিকাশ ও প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অবদান অপরিসীম। বর্তমান সময়ে ও নদীর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে নদী নিয়ে নতুন করে কথা-বার্তা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে নদ-নদীগুলোকে মরতে দেয়া যাবে না, হারিয়ে যাতে না যায় সে ব্যাপারে শ্যেন দৃষ্টি রাখতে হবে। নদী পরিচর্যার বিকল্প নেই কারণ এরা হলো ধরণীর ধমনী – রক্ত সঞ্চালক বা arteries। সাম্প্রতিক সময়ে নদী নিয়ে যে চিন্তা-ভাবনা, তৎপরতা এসব নিয়েই ক্ষুদ্র অবয়বের এ প্রবন্ধ ।
২০০৫ সালে প্রথম বারের মতো বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হলো । Water For Life Decades উপলদ্ধি থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে নদীর আবশ্যকতাকে যেমন স্বীকৃতি দেয়া হলো তেমনি সদস্য রাষ্ট্রগুলো তথা বিশ্ববাসীকে নদী রক্ষার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হলো। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে চতুর্থ রবিবারে এ দিবস পালন করা হবে এ সিদ্ধান্তের সাথে অনেক দেশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব নদী দিবসে শ’য়ের বেশী রাষ্ট্র যোগ দেবে বলে জানা গেছে। আয়োজকদের আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই তবে সবচেয়ে আনন্দিত মানুষটি নিশ্চয়ই কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নদী প্রেমিক প্রফেসর (আজীবন) মার্ক অ্যাঞ্জেলো। তারই সদিচ্ছা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব নদী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। Rivers are the arteries of our planets, they are lifelines in the true sense এ পরিপুষ্ট উপলব্দি থেকে তিনি নদী নিয়ে কাজে নেমেছেন । এ পর্যন্ত গবেষণার প্রয়োজনে হাজারের ও বেশী নদ-নদী পরিভ্রমণ করেছেন । তাঁর পর্যবেক্ষনমূলক গবেষণার আলোকে তিনি তিনশ’র মতো প্রবন্ধ লিখেছেন । জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী এ দুয়ের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর প্রকাশনা বিশ্ব নদী দিবস প্রাসঙ্গিকতা বিষয়টিকে সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহাতীত ভাবে ।
২০২৩ সালের বিশ্ব নদী দিবসের মূল থিম হলো বিশ্বের প্রায় ২৬৫টির মতো বড় নদীর উপর বিশেষ আলোকসম্পাত করা। তবে, এ সংখ্যার মধ্যে ৩৬টি নদী রাশিয়ায় অবস্থিত। এজন্য অনেকে মনে করেন এবারে বিশ্ব নদী দিবস পালন রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্হিতিতে কিছুটা হলে ও খন্ডিত হবে। আশার কথা, যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের গ্রীন একটিভিষ্টরা প্রচুর সংখ্যায় বিশ্ব নদী দিবস পালনে এগিয়ে আসবে। নদী ব্যবস্থাপনায় প্রেসিডেন্ট ফ্রান্কলিন ডি রুজভেল্ট প্রবর্তিত অর্থনৈতিক ও সমাজ উন্নয়ন কৌশল গ্রীণ নিউ ডিল ও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু যুক্ত করে যে সংমিশ্রণ কৌশল সাংবাদিক ফ্রেডম্যান উদ্ভাবন করেছিলেন জাতিসঙ্ঘ তা বিশ্ব নদী দিবসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে অর্জন সুগম করবে এ অনুমিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বিশ্বব্যাপী গ্রীন একটিভিষ্টদের মধ্যে সাড়া পডে যায়।
আগ্রহের সাথে নবায়নযোগ্য এনার্জি ও সম্পদের দক্ষ ব্যবহার করার উপর নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করার প্রবণতা মাথা চাঁডা দিয়ে ওঠে। জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচী UNEP নজরে আসলে বিকল্প জ্বালানী ধারণাটি তারা জনপ্রিয় করতে সক্রিয় হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন উদ্যোগে স্বাভাবিক ভাবেই নদী প্রসংগ যুক্ত হয়। আমেরিকার সাথে সাথে ইউরোপ, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ যেমন আইসল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারলল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, কোষ্টারিকা, ইথিওপিয়া, এমনকি ব্রাজিল ও গ্রীণ নিউ ডিল ও জলবায়ু পরিবর্তন তথা নদী শাসন ও পরিচর্যার মত বিষয়গুলোর একত্রীভূত কাঠামো ও কর্মসম্পাদন কৌশলকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর যাবত বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হয়ে আসছে। ২০২১ সালে পালিত দিবসটি নানা কারণে আলোচিত। গ্রীন উৎসুক যুব সম্প্রদায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক, রিভার কিপারস্ এবং অন্যান্য বেশ কিছু সংগঠন Waterways in our Communities উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শ্লোগান সহকারে দেশের ৫১টি স্হানে রেলী, মার্চ, মানববন্ধন ও বর্ণাট্য সমাবেশের আয়োজন করে। নদীবিধৌত দেশটিতে নদী বিষয়ক বিভিন্ন নাজুক ইস্যুতে সচেতনতা সৃষ্টি, নদী বাঁচানোর যুক্তিযুক্ত আকুল আবেদন, নদী-নালা আবর্জনা মুক্ত রাখা, প্লাষ্টিক সহ যাবতীয় বর্জ খাল-বিল, ড্রেন ও নদী-নালায় নিক্ষেপ না করার উদাত্ত আহ্বান সহ পানির ব্যবহারে সংযত হওয়া সম্বন্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় । সুন্দরবন রক্ষায় সেখানকার নদীগুনোকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ থিমের আওতায় পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বাগেরহাটের মংলায় মেরিন ড্রাইভ রোডে মানববন্ধন ব্যুহ তৈরী করে। প্রশাসনের নাকের ডগায় জেলেরা যে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরেন তার নিন্দা করা হয় এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
কিছু কিছু শহর বন্দরে নদী শাসন ও পরিচর্যা বলতে কিছুই নেই। নগরীর কর্ণফুলীর পাড়ে বসত বাড়ি স্থাপন ও নদীতে বর্জ নিক্ষেপ এসব মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। ফলত নদীটি তার নাব্যতা হারাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীতে বসবাস এখন দুংসহ অভিজ্ঞতা। ড্রেন, খাল-নালা প্লাস্টিক ও বর্জে ভরপুর হয়ে পানি নিষ্কাসনে বাঁধা হয়ে দাঁডিয়েছে। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা। এককালের সৌন্দর্য মন্ডিত নগরীর পানি দূষিত। কোন নিরিখেই চট্টগামকে স্বাস্থ্যসম্মত নগরী বলা যায় না। কর্ণফুলীর অবস্থা দেশের অনেকগুলো নদীর ক্ষেত্রে ও সত্য। কপোতাক্ষ, ইছামতী, তুরাগ, বালু, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, রূপসা, বাঙালি, সুতরাং, খোয়াই ইত্যাদি নদীর অবস্হা ও সংগীন। কিছু কিছু নদীর পানি প্রবাহ বর্ষাকাল ব্যতিরেকে বন্ধ থাকে; বেশ কিছু নদী মরে গেছে ।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষপুত্র, সুরমা ও কুশিয়ারা এসব বড় নদীগুলোর ২৩০টি শাখানদী আছে। প্রায় ২৪১৪০ কিলোমিটার এসব নদীর দৈর্ঘ। নদীবিধৌত এলাকা প্রায় ৮২৩৬ স্কয়ার কিলোমিটার। নদীগুলোকে উপযোগী পরিচর্যার মাধ্যমে বাঁচাতে না পারলে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটির কি অবস্থা হবে তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। দেশটির মানুষ, জীবজন্তু, বৃক্ষরাজিসহ সীমিত বনভূমি, এমনকি কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বহুলাংশে নদীর উপর নির্ভরশীল। মাছে-ভাতে বাঙালির খাবারের সংস্থানে নদ-নদীর ভূমিকা ব্যাপক। ছোট্ট আয়তনের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ অধ্যুষিত দেশটি নদীর কল্যাণ না পেলে বেঁচে থাকতে পারবে না – এ সত্য অস্বীকার করার কোনও জো নেই।
নদী নিয়ে আমাদের উদ্বেগ সীমাহীন। বাংলাদেশে যে ৫৯ অভিন্ন নদী আছে তার ৫৪ টিরই উৎপত্তি ভারতে অর্থ্যাৎ এগুলো ভারতে উৎপন্ন হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। বৃহৎ ও শক্তিশালী উজানের দেশ ভারত আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীতে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ছোট বড় স্থাপনা তৈরী করেছে। শত আপত্তি সত্বে ও এসব কর্মকান্ড অবযাহত রেখেছে। ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশে এর বিরূপ প্রভাবে খরা, বন্যা, সেচের জন্য পানির অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যা নিত্য-নৈমিত্তক ব্যাপার হয়ে দাঁডিয়েছে। দু দেশের মধ্যে নদী ও পানি শেয়ারিং ব্যবস্থা প্রায় নেই বল্লেই চলে। ফারাক্কা চুক্তি আছে বটে তবে এ থেকে বাংলাদেশ পানির নায্য হিসসা পাচ্ছে না। ভারতের অনীহা কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদী থেকে সেচ সুবিধা ও মৎস্য আহরণের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরেন্দ্র ভূমি সহ উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ফেনীসহ অনেক অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে তিস্তার অবস্থার সাজুস্য আছে। ভুলে গেলে চলবে না যে নদী বাঁচলে তবেই বাংলাদেশ বাঁচবে।
Posted ১২:১১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh