বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

মানবিক নজরুল

ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ   |   বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৩

মানবিক নজরুল

মানবিক অধিকারের দাবি, মানবিক মন দিয়ে মানুষ ও তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক অবস্থার পর্যালোচনায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে প্রত্যক্ষণ, নাটকে, সঙ্গীতে, গদ্যে, উপন্যাসে অকূতোভয়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ – এই ছিল নজরুল সাহিত্যের মূল সুর ও ধারা। সার্বজনীনতার চেতনা তাঁর সৃষ্টিতে যেমন মূর্তমান তেমনটি বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকের মধ্যে দেখা মেলে। নজরুলের প্রেমের কবিতা ও গানে ও মানবতার অপার মাধুর্য নিরন্তর বিদ্যমান। তাঁর গীতিকাব্য/নাটক ‘বিদ্যাপতি’তে এ ধারাটি অত্যন্ত জোরালোভাবে ফুঁটে উঠেছে।

একজন গবেষক ও পন্ডিত নজরুলের নাট্য দর্শনে মানবিক দিকটির জয়জয়াকার করতে গিয়ে লিখেছেন, “নজরুলের নাট্য রচনার মূল উৎস হলো স্বাধীনতা, মুক্তি, মানবতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং প্রেম-ভালোবাসার। অশান্ত পৃথিবীর অন্যায়, জুলুমের অবসান । পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির দৃঢ প্রত্যয় । বিশ্ব মানবতার জয়গান । মানুষের আন্তচেতনাকে জাগ্রত করা। সুন্দরের স্বরূপ উন্মোচন,” (ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম, আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিবৃত্ত ও সমাজচিত্র, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম: শব্দশিল্প প্রকাশন, ২০১৬, পৃ ৩৭৬) ।


মানবিক অধিকারের দাবী নজরুলের কাব্য সাহিত্যের এক অনন্য সৌন্দর্য । সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে ওঠে নজরুল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় দিয়েছেন তা এক কথায় তুলনাহীন। অসম্ভব শক্তিমান এই লেখকের বিচরণ সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত ছিল। বিশ্বকবির রচিত গানের সংখ্যা মেলে কিন্তু কবি নজরুলের লেখা সংগীতের সঠিক সংখ্যা আজ অবধি নিরূপণ করা যায় নি। এ সংখ্যা কেউ কেউ বলেন চার থেকে পাঁচ হাজারের ও বেশি হবে। তাঁর নিজের লেখা অসংখ্য গানে তিনি সুরারোপ করেছেন যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

নজরুলের কাব্য প্রতিভা বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে । তাঁর জীবন ছিল বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় ভরপূর । ভবগুরে জীবন যাপন করেছেন অনেক বছর। দারিদ্রের কষাঘাত সহ্য করেছেন বহুদিন। জীবনে সংগ্রাম ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। লেটো’র দলে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাঙালি প্লাটুনে সৈনিক ও হাবিলদার হিসেবে সেনা ছাউনিতে থাকার অভিজ্ঞতা, এবং ভারতের স্বধীনতার সংগ্রামে সংপৃক্ততা তাঁর জীবনে ও সাহিত্য কর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। খুব কাছ থেকে মানুষের কষ্ট, মানুষের উপর মানুষের অমানবিক আচরণ ও অত্যাচার, বৃটিশ শাসনের শোষণ ইত্যাদি, এবং সর্বোপরি নিজের জীবনের কষ্ট তাঁর লেখনীতে সাবলীল, বলিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ফুঁটে উঠেছে। তাঁর সাম্যবাদ কাব্যে এ সবের পরিচয় মেলে।


নজরুল শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি সাম্য ও মানবিক আদর্শের সমন্বয়ে ধর্মবিভেদ ও বর্ণবৈষম্য নেই এমন সমাজের স্বপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। নজরুল কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। প্রেমের ক্ষেত্রে ও তিনি ক্ষুদ্র সামাজিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদকে তুঁডি মুখ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাই বলে নজরুল বিধর্মী ছিলেন না। সকল ধর্মের নির্যাস ছেঁকে মানবিক ধর্মকে কাব্যে ও সাহিত্যে স্হান দিয়েছেন পরম মমতায়। গজল, হামদ, নাত, কাওয়ালী, শ্যামা সঙ্গীত, ভজন, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী – এসব তাঁর মত আর কেউ বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেন নি। নারীমুক্তি, নারীর প্রশস্তিতে তিনি ছিলেন অনন্য। নজরুলের কবিতা, গান, যাত্রা, নাটক ও উপন্যাসে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা দীপ্তিময় হয়ে আছে; ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুশাসন ও সর্বপ্রকার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল মানবিক ও বিদ্রাহী নজরুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট । এসবের কারণে রাজদ্রোহে নিপতিত হয়ে জেল ও খেটেছেন কয়েকবার।

বিদ্রোহের কবি, আনন্দের ও প্রেমের কবি নজরুলের সৃষ্টিকর্মে মানবিক দিকটি সুন্দর ভাবে উন্মোচন করেছেন গোলাম মুরশিদ তার ‘বিদ্রাহী রণক্লান্ত নজরুল জীবনী’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থটিতে। দশটি অধ্যায়, উপসংহার ও পরিশিষ্ট, নির্বাচিত গ্রন্থতালিকা ও নির্ঘন্ট মিলিয়ে ৫৩৭ পৃষ্টার বড়ো কলেবরের পুস্তক; তবে পাঠে ধৈর্য্যচুতি ঘটে না।


শুরুতেই তার এ গবেষণা কেন প্রয়োজন হলো তা বলতে গিয়ে বলেন যে নজরুল’কে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে তবে এগুলোতে “বীরপূজা” ও “অতিশয়োক্তি” লক্ষ্য করা যায়। কিংবদন্তি-নির্ভর এসব লেখায় অতিরঞ্জন, প্রেক্ষাপট নির্ণয়ে অনিশ্চয়তা, বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার অভাব ইত্যাদি লেখকের কাছে পীডাদায়ক মনে হয়েছে। গবেষক আরও লক্ষ্য করেছেন যে ভক্তিবাদ ও রহস্যময় বিষয়ের প্রতি কবির কৌতুহল ছিল সীমাহীন; তিনি দারুণ ভাবপ্রবণ, স্পর্শকাতর এবং অভিমানী ছিলেন। গোলাম মুরশিদ মনে করেন, পিতার পরিবার থেকে স্নেহের তৃষ্ণা না মেটায় পরবর্তী কালে পরিবারের বাইরে – পরিচিতদের মধ্যে কবি সেই দুর্লভ স্নেহ-সুধা অন্বেষণ করেছেন। কবি’র চরিত্রের আরও দুটি বৈশিষ্ট, লেখকের মতে চাঞ্চল্য এবং অজ্ঞাত স্থানের প্রতি তার দূর্বার আকর্ষণ। কবিত্ব ও সংগীত তার স্বভাবেই ছিলো।

জন্ম-বাউন্ডেলে কবি তার স্বল্পকালের জীবদ্দশায় আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন নতুন ধারা সংযোজন করেছেন যা মোহিতলাল মজুমদার, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর’কে ও বিমোহিত করেছিল। “আধুনিক বাংলা কবিতায় তার মতো ব্যাপকভাবে স্বরবৃত্ত ছন্দ অন্য কোন কবি ব্যবহার করেছেন কিনা, সন্দেহ আছে।” পৃষ্ঠা ৩১।

বৃটিশ শাসকের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার বিপ্লবী পথের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন নিবারণ চন্দ্র ঘটক,- শিয়ারশোল স্কুলে পড়াকালীন সময়ে নজরুলের প্রিয় শিক্ষক, কিন্তু অস্হিরমতির নজরুল হঠাৎ করেই অনেকটা হুজুগের বশেই বাঙালি পল্টনে নাম লেখালেন এবং কৃতকার্য হয়ে করাচি গিয়ে যোগদান করে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি তবে সেনা প্রশিক্ষণ ও সহকর্মীদের সাথে গান-বাজনা, কবিতা পাঠ, ভাষা শেখা ইত্যাদি ভালভাবেই রপ্ত করেন। সেখানে থাকার সময় প্রচুর কবিতা মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত ইত্যাদি পত্রিকায় পাঠান যদিও এগুলো বেশীর ভাগই ছাপার উপযুক্ত মনে হয়নি সম্পাদকদের কাছে। গোলাম মুরশিদ ১৯১৮ থেকে ১৯২০ এ কলিকাতা ফেরার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে নজরুলের গল্প ও কবিতা প্রকাশের প্রয়াস সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সওগাত (নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯১৮) ও এপ্রিল-মে, ১৯১৮ মাসের বংগীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় এ সময়ে তার দুটি লেখা প্রকাশিত হলে তিনি নব উদ্যমে লেখালেখির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে সাফল্য ছিলো খুবই সীমিত।

১৯১৯ সালের শেষদিকে নজরুল সেনা ছাউনি থেকে ফিরে মাস দুয়েক চুরুলিয়া, শান্তিনগর, শিয়ারশোল ইত্যাদি পুরোনো বিচরণ ক্ষেত্র পরিভ্রমণ করে কলিকাতা এসে বন্ধু শৈলজানন্দের মেস, পরিবর্তীতে মুজাফফর আহমেদ, আব্দুল ওদুদ প্রমুখদের সাথ আস্তানা গাড়লেন সেখান থেকেই নজরুলের কবি প্রতিভার অসামান্য প্রকাশ দেখা যায়। অসাম্প্রয়িক ও মানবিক নজরুল ও বিকশিত হন এ সময়েই। নবযুগ পত্রিকা, ধুমকেতু, মোসলেম ভারত ইত্যাদি পত্র-পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ততা তাকে তার জীবনে সোনালী যুগে উত্তরণে দারুণভাবে সহায়তা করে। মানবিক নজরুলের একটি শুভ্র, সুন্দর দিক এ সময়ে পরিস্ফুট হয় অত্যন্ত বলিষ্টভাবে। নবযুগে ‘নবযুগ’ নামে এক সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেন:

“এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ ! এস ক্রিশ্চিয়ান । আজ আমরা সব গন্ডি কাটাইতাম, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়ে প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।”( পৃ ৯০)। মানুষ ধর্মের বাণী এ সময়ে তার লেখাতে উদগ্র, উদ্দাত্ত আহ্বান হিসেবে বারবার উৎসারিত হতে দেখি । এ সময়েই রাজনীতি ও সেরা সেরা রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচয় হয়। লেটো দলের দোহার থেকে নজরুল কি ভাবে বাংলার একজন শ্রেষ্ট সংগীতকার, বিদ্রোহী , মানবিক ও প্রেমের কবি, গল্পকার হয়ে উঠেছিলেন সে ইতিবৃত্ত গোলাম মুরশিদের গ্রন্হটিতে সুন্দর ও সাবলীলভাবে ফুঁটে উঠেছে । মানবদরদী কবি মানবতার জয় গাইতে গিয়ে ‘মানুষ’ কবিতায় বলেন,

‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান ।’

এই যে শ্বাশত, সার্বজনীন মানসিকতা, মূল্যবোধের জয়গান, তা আমরা নজরুলের কবিতা, গান, বক্তৃতা, উপন্যাস ইত্যাকার সকল সৃষ্টির মধ্যেই অহরহ পাই । বিদ্রোহ, দ্রোহ, প্রেম, মান-অভিমান জীবনের সর্বত্র তাঁর মানবতা বোধ, মানবতাকে সবচে উচুঁ স্হানে দেখতে চেয়েছেন , জীবনের আঁকাবাঁকা পথে, প্রেমে, বিরহে, যুদ্ধে, শান্তি- সন্ধ্যে – এককথায় সকল পর্যায়, পরিস্থিতিতে একে অধিষ্ঠিত করতে সোচ্চার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ।

Posted ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৩

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6363 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1313 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1155 বার পঠিত)

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.