ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৩
ইংরেজি ‘নষ্টালজিয়া’ শব্দটির বাংলা সমার্থক শব্দ খুঁজলাম বেশ কিছুক্ষণ। নষ্টালজিয়া বা নষ্টালজিক শব্দ দুটো মনের গভীরে যেমন সাড়া দেয়, নাড়া দেয়, তেমন শব্দ মাতৃভাষায় না পেয়ে ‘সুখস্মৃতি রোমন্থন’ পদবাচ্যটি শিরোনাম হিসেবে বেছে নিলাম । বিশেষ কিছু মুহূর্তে, সময়ে, ক্ষণে সুখানুভূতির উদয় হয় সকল মানুষের ক্ষেত্রেই, সময়ে সময়ে কথাটি বোধ করি চিরন্তন সত্য। অতীতে ফিরে গিয়ে সুখস্মৃতি যেমন কুঁড়ানো যায়, জাবর কাটা যায়, তা আবার সময় সময়ে কষ্টানুভূতিও নিয়ে আসে। এমন পরিস্থিতিতে হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন বলে, এমনটি না করলেও পারতাম, এমনটি না বললেও ও পারতাম। দীর্ঘদিন পর এ রকম ভাবনা চিন্তা-চেতনে এক ধরণের অনুতাপের আবহ নিয়ে আসে, যা মনের গভীরে দীর্ঘ সময়ের ক্ষেপণে হলেও ব্যথাবোধ জাগ্রত করে, বেদনার পরিস্থিতি নিয়ে আসে, অন্তরকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ক্ষত-বিক্ষত করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এহেন ভাবনা নিশ্চয়ই ক্ষতিকর, বিশেষত, অতীতে ফিরে শোধরানোর ব্যবস্থা নেওয়া যখন অবাস্তব চিন্তা এবং অসম্ভবও বটে। অনুতাপ মনকে পরিশুদ্ধ করে সত্যি, তবে সময়ের নিরিখে অতীত কষ্ট ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। গুণীজনেরা বলেন, অতীতের প্রেমজনিত কষ্ট, ধারে দেওয়া টাকা ফেরত না পাওয়ার বেদনা ইত্যাকার বিষয় ভুলে যাওয়াই ভালো। মানসিক দৈন্য, স্বাস্থ্যের অবনতিসহ মনের অপ্রসন্ন অবস্থা ঠেকাতে হলে এ অবস্থার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। আর তা হলো, আত্মতৃপ্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। সে পর্যায়ে পৌঁছানোর সোপান হলো সুখস্মৃতি তর্পণ বা রোমন্থন।
জীবনের যে পর্যায়ে পদচারণা, এ সময়ে এখন অতীতদিনের সুখস্মৃতি ফিরে আসবে না সত্যি তবে শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের স্মৃতিময় চালচিত্র মনে করে আনন্দ মিলবে সহজেই। মনে আবেগ, ফেলে আসা উচ্ছ্বাস এবং উচ্ছলতার ঢেউ স্মৃতিচারণে ছিঁটেফোটা আসলেও সে পরম পাওয়া মনের ও দেহের সুস্বাস্থেহর জন্য। সুস্বাগতম এমন সব স্মৃতিকে। তরল স্মৃতি যে আবেগ আনে, হাস্যরসের জন্ম দেয়, তাতে কোন মনস্তাপ সচরাচর থাকে না বরং হাস্যরসের আধিক্যই বেশী মাত্রায় থাকে। বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন, বয়সভেদে নাতী-নাতনী – এ রকম সম্পর্কের বাছাই করা স্বজন-সুজনদের সাথে শেয়ার করে নির্মল সুখানুভূতি মেলে।
ভবিষ্যত চলার পথের ধারণা পাওয়া যায় চাইলে। পুরনো দিনের গান শুনতে, সিনেমা দেখার ইচ্ছে সুস্থ মন-মানসিকতার লক্ষণ। অ্যালবামে পুরানো ছবি ঘাটলেও সুখের অনুভূতি আসে, অতীত সুখস্মৃতি মাথা চাঁড়া দেয়। অতীতে পাঠ করা কিছু কিছু বই পুনর্বার পড়া সুস্থ মনের পরিচায়ক বলে মনে করি। মন আলোকিত, আলোড়িত করেছিল এমন সব নাটক, উপন্যাস, গল্পের বই, ভ্রমণ কাহিনী, ধর্মীয় বা পৌরাণিক পুস্তক, কল্পকাহিনী, আদি রসাত্মক কবিতা, শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, প্রায় বিশ্রুত ঐতিহাসিক কাহিনী, তথ্য, অতীত এবং প্রবহমান দর্শন ইত্যাদি নেড়েচেড়ে দেখা, এসব চর্বিত চর্চ্চা হলেও মানসিক সুস্বাস্থের পক্ষে অতি কল্যাণকর। নিত্য, এমনকি কখনো-সখনো এমন জগতে পদচারনা এক ধরণের আনন্দ অনুভূতি নিয়ে আসে। বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা, সে মুখোমুখিই হোক, বা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের হোক না কেন, তা চিত্তবিনোদনের সাথে সাথে অজস্র সুখস্মৃতি নিয়ে আসে।
এগুলো সবই স্মৃতিচারণের একক বা সম্মিলিতভাবে সুখ স্মৃতিচারণের মোক্ষম মাধ্যম। এমন সব উপায় অবলম্বন করে আমরা হরহামেশাই আনন্দরস আস্বাদন করি। সাময়িকভাবে হলেও দুংখ কষ্ট ভুলে থাকার মহৌষধ এ জাতীয় অভ্যেস। লেখকরা এহেন স্মৃতিচারণ থেকে তথ্য, উপাত্ত যোগাড় করেন। রূপ, রস, প্রেক্ষিত, কল্পলোকে বিহার, প্রয়োজনে বাস্তবের ছোঁয়া -এসবের মিশেলে তৈরী করতে সমর্থ হন নিত্যনতুন কর্মময় বিশ্ব, নতুন নতুন সৃষ্টি। অতীত ঘেঁটে স্মৃতি রোমন্থন বা জাবরকাটা আমাদের জন্য নানা অবয়বে মনোতৃপ্তি নিয়ে আসে। এ থেকে যে আত্মতৃপ্তি তা জীবনে সুখ-শান্তির পথ সুগম করে দেয়। সুখস্মৃতি রোমন্থনে ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের পথ সুগম হতে বাধ্য।
অক্টোবর ১৬, ২০২৩ ,ম্যানহেচেট হিলস্, লং আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক
Posted ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh