ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
(সেকাল) নব্বই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পাল তোলা ছোট্ট আকারের জাহাজেই ইউরোপের বাসিন্দারা স্বপ্নের দেশ আমেরিকা এবং কানাডায় পাড়ি জমাত সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার আশায়। এদের আমেরিকায় অভিগমনের টুকরো টুকরো কাহিনি নিয়েই এ শিরনামের লেখাটি। বর্তমান সময়েও এ আমেরিকায় বৈধ বা প্রায়শই অবৈধ পন্থায় অভিগমনের প্রবাহ অব্যাহত আছে। আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে মূলত মেক্সিকো হয়ে আসা অভিগমনকারীদেরযাত্রাপথ ভিন্ন হলেও নানাবিদ সমস্যা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। প্রবন্ধটিতে এ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার ইচ্ছে জিইয়ে রেখে আজকের অংশবিশেষের শুরু।
অদম্য স্পৃহা, প্রণোদনা এবং জন্মভূমি ছেড়ে নতুন দেশে আসার স্বপ্ন অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছিল মূলত ইউরোপে থেকে। বিরাজমান সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় দুই শতাব্দী যাবত চলতে থাকা গড্ডালিকা প্রবাহের মতো এ অভিগমণ চলতে থাকে। আদিবাসীদের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধে প্রচণ্ড আঘাত হেনে পুরাতন দুনিয়া ছেড়ে আসা স্বদেশে নিগৃহীত ইউরেপীয়রা নতুন দুনিয়ায় এসে নিজেদের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানায় ক্রীতদাসদের কাজে লাগিয়ে নতুন ধরণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলে। প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এবং নূতন। কয়েক শত বছরের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন রূপান্তরিত ধারণা এবং রূপান্তরে আজকের আমেরিকা।
আমেরিকার আজকের অবস্থানে আসার প্রারম্ভিক দিনগুলো সহজ ছিল না। ছোট ছোট পাল তোলা জাহাজে ৪০০ থেকে ১০০০ যাত্রী নিয়ে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসা দুরূহ ব্যাপার ছিল। ক্ষুধা,রোগব্যাধিতে প্রতি যাত্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ যাত্রী ম্যারা যেত। খাবার সামগ্রী, পানীয় জল প্রাপ্তির অপ্রতুলতা, জরা-ব্যাধি এবং প্রায় অনুপস্থিত চিকিৎসা ব্যবস্থা যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ অবস্থায় নিমজ্জিত থাকত। এ অবস্থা চলত চল্লিশ থেকে প্রায় শ দিন ব্যাপ্তির এসমুদ্র যাত্রায়। পাল তোলা জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রিত হতো বায়ুপ্রবাহের এবং আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার উপর।
অসুখবিসুখ, মানসিক যন্ত্রণা, ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের অমানবিক আচরণ নিত্য ব্যাপার ছিল। নাবিকদের হাতে মহিলাদের শ্লীলতাহানি ছিলসাধারণ ব্যাপার ছিল। এজন্য কোন শাস্তির বিধান ছিলো না। অস্কার হ্যান্ডলিন (Oscar Handlin) তার বিখ্যাত প্রবন্ধ Steerage এ বলেন, Disease was rampant, the monotony was unbearable, petty thievery was common, and women were considered fair game by the seamen.(see, Stuart Hirschberg, Terry Hirschberg in `Past to Present: Ideas that changed our World’, p.296).
যাত্রা মোটেও সুখকর ছিলো না। তা সত্ত্বেও ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ এর হাতছানি ছিলো প্রবল। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার সুযোগ, ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অদমিত আকাঙ্খা মিটানোর আশা, অঢেল পরিমাণ জমির মালিক হওয়ার অপার সম্ভাবনা ইত্যাদি নিত্যই তাদের আমেরিকা আসার ইন্ধন যোগাত। ইউরোপে বিধি- নিষেধের সুকঠিন বেড়াজালে আবব্ধ সমাজ থেকে বের হয়ে মুক্ত জীবন যাপন ইউরোপের, বিশেষত ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি দেশের লোকদের প্রলুব্ধ করেছিল ভীষণভাবে।
তাই শত অত্যাচার, অনাচার ও শত কষ্ট, সহ্য করে এসব দেশ থেকে লোকজন দলে দলে স্বপ্নের দেশে এসেছে। শুরুতে পাল তোলা জাহাজে করে কম পক্ষে ৪০ দিনের কষ্টকর সমুদ্র যাত্রা সম্পন্ন হতো। আবহাওয়া বিরূপ হলে তিন মাসও লেগে যেত অনেক সময়। জাহাজের পাটাতনে পা রাখার পর থেকে যাত্রীদের সর্বক্ষমতার অধিকারী ক্যাপ্টেন ও তার সহকর্মীদের কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে চলতে হতো। তাদের অমানবিক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক যাত্রীই উথাল পাতাল মানসিক যন্ত্রণায় আমেরিকার সীমান্ত রেখা দেখা গেলে চিন্তাভাবনা না করে প্রথম যে স্থানে জাহাজ নোঙর ফেলত সেখানেই নেমে যেত। বন্দরের কোন পূর্ব ঘোষণা অনেক ক্ষেত্রেই থাকতো না বা ক্যাপ্টেন সাহেব জানতেনও না।
খুবই অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অনভিজ্ঞ ও অজ্ঞ চালকের কারণেই এমনটি হতো। জাহাজে ছোটখাট বিদ্রোহ ও হতো তবে ক্যাপ্তান এবং নাবিকরাই জিততেন। ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজ ডুবিতে প্রচুর লোক মারা যেত। ১৮৩০ সালে এমনি এক দুর্ঘটনায় লিভারপুল থেকে কিউবেক যাওয়ার পথে ১৭টি জাহাজডুবির কথা জানা যায়।
জাহাজে আগুন লেগে ও মানুষ মারা যেত। বাষ্পচালিত জাহাজ প্রচলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ২৫০ থেকে ৩০০ টনের ছোট্ট জাহাজে করেই সাগর পাড়ি দিতে হতো। সীমিত পরিসরের এরকম জাহাজে তিনশ থেকে হাজার যাত্রী গিজগিজ অবস্থায় থাকত। সরকার থেকে তেমন কোন নিয়ম কানুন সে সময় চালু ছিলো না। প্রতিযোগিতার বাজার ছিলো না, তাই জাহাজ মালিক ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করত। সাধারণত ভাড়া জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ শিলিং ছিল ।
তবে,খুবই সীমিত সংখ্যক কেবিন ছিল যেগুলো ১০ থেকে ২০ পাউন্ডে প্রধানত সাধারণত জার্মান যাত্রীরা কিনত। সঙ্গতির দিক থেকে আইরিশ যাত্রীরা সবচে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তারা জাহাজের খোলে জায়গা করে থাকত। পালে চলা জাহাজগুলোতে ১০ থেকে ২০ শতাংশ যাত্রী প্রতিবারের যাত্রায় মারা যেত। কলেরা, রক্ত আমাশয়, ইয়েলো ফিভার, গুটি বসন্ত, হাম, এবং শিপিং ফিভার লেগেই থাকতো। হাজার হাজার ইঁদুরের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এ জাহাজগুলো রোগব্যাধিরও আবাসস্থান ছিল।
(চলবে)
ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩
ম্যানহাসেট হিলস, লং আইল্যান্ড ।
Posted ৭:১৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh