মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

বৈরুত ও একটি আহত আত্মার আত্মকথন

  |   বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০

বৈরুত ও একটি আহত আত্মার আত্মকথন

(২য় অংশ) : বৈরুত নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। আজ থেকে সাতচল্লিশ বছর পূর্বে আমি যখন বৈরুত যাই তখন যে সুষমামন্ডিত, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি তিলোত্তমা নগরী দেখেছিলাম ১৯৭৬ এ দেশে ফেরার সময় তাকে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে আসি। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে সাত হাজার বছরের ও বেশী সময় ব্যাপ্তির সুপ্রাচীন সভ্যতার স্বাক্ষী এ সমুদ্র বন্দর ও নগর মাত্র পনের বছরের গৃহযুদ্ধে কেমন করে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রায় দেউদিয়াত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা ভাবলে অবাক লাগে, আমার মত বৈরুত প্রেমিকের কষ্ট লাগে। প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যের সে সময়কার সেরা উচ্চবিদ্যাপীঠ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের লোক প্রশাসন ও রাজনীতি অধ্যয়ন বিভাগের প্রফেসর ড. রালফ গুন্ডারসনের কথা বলি। তিনি আমার সুপারভাইজার ছিলেন। অত্যন্ত প্রতিথযশা শিক্ষক। আমাদের পলিটিক্যাল ইকোনমি বিষয় পড়াতেন। আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে থিসিস ও করছিলাম। তৃতীয় বারের মত বাংলাদশেস্থ ইউএসএইড অফিস যখন বৈরুতে ফেরত পাঠালো তখন প্রফেসর গুন্ডারসন খবর পাঠালেন তাঁর বাসার বৈকালিক স্ন্যাক খেতে। গেলে তাঁর স্ত্রী আমাকে নিয়ে বসলেন। বললেন, তিনি খুবই কষ্টের সাথে জানাতে চান যে তারা এ প্রিয় শহরটি ছেড়ে কালই চলে যাচ্ছেন কালিফোর্নিয়ায়। আমার তো মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ার উপক্রম। দু’এক দিনের মধ্যে থিসিস জমা দেব, ডিফেন্স হলেই দেশে চলে যাব কারণ আমার কোর্স সবগুলো বেশ আগেই শেষ করেছি, এমনকি কম্প্রিহেনসিভ ও শেষ। এখন সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর সান্নিধ্যে ফিরে যাওয়ার সময়। যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন (ড.) মিসেস গুন্ডারসন। বল্লেন, দেখ, আমরা জানি দেশে তোমার নব বিবাহিত স্ত্রী ; তাছাড়া, এমনিতে যে প্রোগ্রাম অনায়াসে দেড বছরে শেষ করার কথা বৈরুতের পরিস্থিতির কারণে তা দুই বছরের বেশী সময়ে ও করা যায়নি। তবে, প্রফেসর থিসিস বিষয়ক সকল কথাবার্তা চেয়ারপার্সন আদনান ইস্কান্দরের সাথে করে গেছেন। তার ধারণা দিন দশেকের মধ্যে তোমার ডিগ্রী এওয়ার্ড হয়ে যাবে। এ সময়ে শীতল পানীয়ের ট্রে নিয়ে প্রফেসর যোগ দিলেন। যেন শেষ কথাটি শুনতে পেয়েছেন ; রেষ ধরে বল্লেন, ফাইন্যাল সার্টিফিকেট তোমার দেশের ইউএসএইড অফিসে চলে যাবে। তোমাদের পৌঁছে দেবে যেখানেই থাক। বারংবার ‘সরি’ বলে বল্লেন, জীবনের ঝুকিটা বড় সন্নিকটে মনে হচ্ছে। অনেক প্রিয় এই শহরটি ছেড়ে চলে যাব ভাবতে দারুণ কষ্ট লাগবে। তোমাদের রেখে যাচ্ছি এও মনোকষ্টের। প্রাচ্যের আতিথেয়তার রীতি ধরেই মনে হলো বল্লেন আমি যেন উনাদের সাথে নৈশ ভোজ খেয়ে যাই। আসলে, কথা বলতে, গল্প করতে চাচ্ছিলেন আমার মন হাল্কা করার জন্যই নিশ্চয়। নইলে আমেরিকান প্রথায় এমন হঠাৎ করে কেউ কাউকে আপ্যায়ন করেনা। প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেলে বললাম, তোমাদের তো কাল যেতে হবে গোছগাছ সম্পন্ন তো নাকি কাল বাংলাদেশী দু’তিন জন নিয়ে এসে হাত লাগাব। একসুরে অত্যন্ত সুন্দর মনের সুদর্শন দম্পতি বলে উঠলেন যে গোছগাছ শেষ, কিছু মালপত্র কালিফোর্নিয়া পৌঁছে ও গেছে। বল্লেন, গাডীটি কাল জাহাজে উঠবে। আমাকে লিফ্ট দিতে চাইলে রাজী হলামনা এই বলে যে গাড়ীর হেড লাইট লক্ষ্য করে স্নাইপারদের গুলি খেয়ে তিনজনই মরব তাহলে। নাছোড়বান্দা তারা। এত রাতে একা ছাড়বেন না। পনের মিনিটের রাস্তা হেঁটে আমাকে খালদী রোড়ের এপার্মেন্টের গেটে পৌঁছে দিলেন। শেষ কথাটি ছিলো, জীবনের ঝুঁকি দেখলে দ্বিরুক্তি না করে চলে যাবে।

এমন চমৎকার মানুষের শেষ কথাটি আমার বেলায় এবং আরও ক’জন বাংলাদেশী ছাত্রের বেলায় একেবারে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রফেসর গান্ডারসন চলে যাওয়ার পরের দিন সোমবার বাঁধানো থিসিস হাতে পৌঁছলে তা বিভাগে গিয়ে প্রফেসর আদনান ইস্কান্দরের কাছে জমা দেই। পরবর্তী সোমবার দশটায় ডিফেন্সের তারিখ দেন। বিকেলে জাহানারা আপা (ইডেন কলেজে বাংলার অধ্যাপক), মনোয়ারা আপা ও রওশন আপা (দু’জনই অধ্যাপনায় ছিলেন ) আমার এপার্টমেন্টে সকাল এগারোটার দিকে এসে গরুর মাংস রান্না-বান্না করে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেন। বিকেলে হামরা স্ট্রিটে বাজার করতে গেলেন। সন্ধ্যেয় ফিরে এসে হাল্কা নৈশ ভোজ করলেন। আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীডাপীডি শুরু করলে উনাদের সাথে পশ্চিম বৈরুতে তাদের এপার্টমেন্টে গেলাম। গিয়ে দেখি পরিপাটি করে আমার জন্য বিছানা ও রেডি। বুঝতে কষ্ট হলো না যে এ ব্যবস্থা প্রি-প্ল্যানড। উনাদের এলাকায় প্যালেইষ্টানি বেশী। গুলি-গোলা পডছে নিত্যদিনই। তাই, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। অবশ্য, আমাকে বার বার বলছিলেন, আমি একা তাই নিয়ে এসেছেন। আমার এলাকা পূর্ব বৈরুত তেমন আক্রান্ত ছিলোনা যদি ও গোপ্তাগুলিতে অনেকেই আহত -নিহত হয়েছে। আমি নিজে ও ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে বেঁচে গেছি। দিন দশেক পূর্বে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি থেকে সন্ধ্যের সময় নাইজেরিয়ান বন্ধু ওমরসহ ফিরছি। এইউবি হাসপাতালের পেছনের গেটটা সবেমাত্র অতিক্রম করেছি। স্নাইপারের গুলি এসে ওমরকে বিদ্ধ করে। ওমর আহত হয়েছিল গুরুতর ভাবে। মধ্যপ্রাচ্যের সেরা হাসপাতালের অভিঙ্গ ডাক্তার, সার্জনদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বে ও ঘন্টা দু’য়েক পরে আমার প্রিয় বন্ধু ওমর মারা যায়। পাশাপাশি হাঁটছিলাম। বুলেটটি ওমরকে বিদ্ধ না করে আমার গায়ে ও লাগতে পারত। আল্লাই বাঁচানে ওয়ালা।


আপাদের বাসায় আসার বড়জোর পনের মিনিটের মধ্যেই আশেপাশে কয়েকটি গোলা পরে। আমার ভাল ঠেকছিল না। বল্লাম, চলেন আমার এপার্টমেন্টে চলে যাই, দুটো কক্ষ খালি আছে। আমি এত বড় বাড়ীতে সম্পূর্ণ একা। বাড়ীর মালিক দ্রুজ। পেশায় ডেন্টিস্ট। কারোর সাতেপাচে নেই। তিন মেয়ে, এক মেয়ের জামাই ও দু’জন নাতী-নাতীন নিয়ে থাকেন। একই বাড়ীতে আমরা থাকি। সবসময়ই তথ্য-তালাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়, মধ্যপ্রাচ্যের সেরা হাসপাতাল এবং হামরা বাণিজ্যিক এলাকার কাছে হওয়ায় পূর্ব বৈরুতের এ অংশটি অনেকটা বাফার জোনের মত। নিরাপদ ও বেশ। উনারা রাজী না হওয়ায় এক পর্যায়ে আমি রাগ করেই বেড়িয়ে পরি। শেষরাত্রে কলিং বেলের শব্দ। থামতে চাচ্ছে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আপা তিনজন গাট্টি-বোচকা নিয়ে নীচে দাঁডিয়ে। চার তলা থেকে নীচে নেমে উনাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসলাম। কাহিনী শুনলাম। আমি ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই একটি শেল তাদের এপার্টমেন্টের সামনে বিস্ফোরিত হয়ে আটটি প্যালেইস্টাইনী বাচ্চা ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। রাত দুইটা- আড়াইটার দিকে আরেকটি শেল আমার জন্য যত্ন করে তৈরি বিছানাটা বিদীর্ণ করে ফ্লোর ভেঙ্গে কক্ষটিকে দুমডে-চুমডে দিয়েছে। আল্লাহ -তায়লা বাঁচানেওয়ালা ।

গৃহযুদ্ধে বৈরুত নগরী বিভক্ত হয়ে গেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এটি বৈরুতে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। প্রথমটি হয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে। মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের এর আহ্বানে প্যান-আরব আন্দোলনে সাড়া দিলে মেরোনাইট খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত বাঁধে। শুরু হয় তুমুল গৃহযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। লেবাননের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চামেলী শ্যামনকে (ঈধসরষষব ঈযধসড়ঁহ) অপসারণ করে জেনারেল চেহাবকে (এবহবৎধষ ঈযবযধন) প্রেসিডেন্ট পদে বসায়। এর সতের বছর পরে দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ বাঁধে। প্রথম দিকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফোর্সের প্রত্যক্ষ মদদে পরিচালিত ন্যাশন্যাল মুভমেন্টকে ব্যর্থ করতে খ্রিস্টান-মেরোনাইট লেবানিজ ফোর্সেস মাঠে নামে। তারা তেল-জাতির ও ক্যারানটিনা – এ দু অঞ্চলের প্যালেস্টাইনীদের কঁচুকাটা করে। প্রতিশোধ নিতে পিএলও ও জর্ডানের বাদশাহ হোসেনের তাড়া খেয়ে লেবাননে পালিয়ে আসা প্যালেইস্টানীরা ডেমোর অঞ্চলের খ্রিস্টানদের উপর হামলা চালায়। লেবাননের আইন-শৃংখলা বাহিনী ছিল অত্যন্ত দূর্বল। গোষ্ঠিগত কোন্দল ও আভ্যন্তরীণ বিভক্তিতে অন্তসারশুন্য। দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে আমেরিকার পরামর্শে সিরিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সিরিয়ার হাফেজ আল-আসাদ সুযোগ ছাড়ার পাত্র নন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ও ইরাক -ইরানের শিয়া মুসলমানরা ও তলে তলে তাই চায়। সিরীয় বাহিনী এক ধাক্কায় লেবাননের সর্ব দক্ষিণ অঞ্চল ব্যতিরেকে পুরো লেবাননের আধিপত্য নিয়ে নেয়। ১৯৭৬ সাল থেকে নিষ্ঠুর কাহিনীর এই যে শুরু তাতে ইসরাইয়েল জডিয়ে পরে ১৯৭৮ সালে। আমি অবশ্য সিরীয় বাহিনী বৈরুতে অবস্থান নেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই দামেস্ক হয়ে দেশে ফিরে আসি। তবে, ডিগ্রী নিয়ে আসতে পারিনি সে যাত্রা। বিপদ মাথায় নিয়ে ও ডিফেন্স দেয়ার তারিখে বিভাগে গিয়ে চেয়ারপার্সনের ধমক খেয়ে সেখান থেকেই ইউ এস এ্যাম্বেসীতে গিয়ে দেশে যাওয়ার টিকেট ও সিরিয়া কাফেলার শরিক হওয়ার অনুমতি পত্র যোগাড় করি। পূর্বে উল্লেখিত আপা তিন জনকে খবর দিলে তারা ও আমার পথ অনুসরণ করেন। অপেক্ষায় থাকি কবে দামেস্ক রওয়ানা দেবে আমেরিকা দূতাবাস আয়োজিত গাড়ীর কাফেলা। (চলবে)


advertisement

Posted ৬:৫২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1286 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.