ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০
(তৃতীয় অংশ ) : বৈরুতকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। আমি যখন লেবাননে যাই ১৯৭৩’র আগস্ট মাসে তখন যে তিলোত্তমা নগরী দেখেছিলাম ১৯৭৬’র জানুয়ারীতে ফিরে আসার সময় দেখেছি গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত এক জনপদ। পনের বছর ব্যাপ্তির এক নোংরা এবং নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ সুন্দর এ শহরটিকে, দেশটিকে হতশ্রী করে দিয়েছে, অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া করে ফেলেছে। যে কোন নিরিখে, সে হোকনা অর্থনীতি বা সংস্কৃতি, সুপ্রাচীন কাল থেকেই দজলা- ফোরাত বিধৌত অঞ্চল থেকে লিটানি নদীর পাদদেশের বিস্তৃত এলাকার ব্যবসা-বানিজ্যের পন্যসম্ভারের আনা নেয়া ঐতিহাসিক ভাবে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত নয়নাভিরাম রৈুতের মাধ্যমেই সম্পাদিত হতো। ক্রুসেডের সময়ে বেশ কিছু জনপদ খ্রিস্টানদের দখলে গেলে ত্রিপলি, আক্রে, আন্তিওফ ইত্যাদি স্থানের বন্দরগুলো ও ব্যবহার হতে থাকে। এদিকে, সাইপ্রাস ও খ্রিস্টানদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। বৈরুতে নোঙ্গর ফেলত এমন অনেক বাণিজ্য তরী নিকোশিয়ার নিরাপদ বন্দরে ভিড় জমায়। সমুদ্র বন্দর ও পোতাশ্রয় হিসেবে বৈরুতের আবেদন কিছুটা কমে যায়।
বৈরুতের হাত বদল হয়েছে অনেকবার। প্রায় সাত হাজার পূর্বে ফোনেসিয়ানদের প্রতিষ্ঠিত সমুদ্রকেন্দ্রিক (maritime) সংস্কৃতি তিন হাজার বছরের মত ভালভাবেই ঠিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে রোমানরা বৈরুত ও মাউন্ট লেবানন দখল করে নেয়। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর বৈরুত খ্রিস্টানদের মঠ সন্ন্যাসী বলে খ্যাত মেরনাইট (Maronite) সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। এদের মূল গির্জা মাউন্ট লেবাননে হলে ও আনাচেকানাচে অনেক মঠের বিস্তার ঘটে। বৈরুত জনপদ কালক্রমে হয়ে যায় মেরনাইট নগরী।
এগার শতকে মুসলমানদের আধিপত্যের সময় শিয়াদের একটি শাখা থেকে উদ্ভূত দ্রুজ (Druze/Druz) সম্প্রদায় ও মাউন্ট লেবাননের দক্ষিণ এলাকায় নিজেদের স্থান করে নেয়। এদের সামন্ত বা ফিউডাল পরিবারগুলো উত্তরাঞ্চলে বসবাস করছিল তবে চৌদ্দ শতকে মামেলুকদের আক্রমণে তাদের আধিপত্য চুরমার করে দেয়া হয়। উল্লেখ করা যে ধর্মীয় এ বিভাজন লেবাননে আজো ঠিকে আছে। ক্রুসেড চলা কালে মেরনাইটরা রোমান চার্চের সাথে যোগাযোগ জোরালো করে। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোম্যান সাম্রাজ্য লেবানন দখল করে নেয়। এ শাসন চার শত বছর অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বলবত ছিলো। ১৯২০ সালের সেভরস (ঝবাৎবং) চুক্তি অনুযায়ী ফ্রাঞ্চ আধুনিক লেবাননের পাঁচটি বিভাগের শাসনভার পায়। ১৯২৬ সালে লেবাননকে রিপাবলিক হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং একটি শাসনতন্ত্র ও প্রণয়ন করা হয়। ফ্রান্স মাউন্ট লেবাননে আরও অধিক সংখ্যক মুসলমানদের নিতে মেরনাইট ও দ্রুজদের বাধ্য করে। ১৯৪৩ স্বাধীনতা লাভ করলে লেবানন ১৯২৬ সালের কন্সটিটিউশন পরিবর্তন না করে একটি বিশেষ ধরনের সরকার ব্যবস্থা চালু করে (Confessional form of government)। এ পদ্ধতির সরকারে প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে বিশেষ বিষয়ের ক্ষমতা দেয়া হয়। ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত।
স্বাধীনতার পর মেরনাইট খৃষ্টান বেকারা এল-খুরি (Bechara El-Khoury), সুন্নি মুসলিম রিয়াদ এল-সোল (Riyad El-Solh) প্রধান মন্ত্রী এবং দ্রুজ মতাবলম্বী শিয়া মজিদ আরসালান (Emir Majid Arsalan II) যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী এবং ডিফেন্স মিনিস্টার পদে সমাসীন হন। স্বাধীন লেবাননের এ তিন প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র ক্ষমতা ভাগাভাগির যে নিয়ম বা ঐতিহ্য রেখে গেছেন আজতক ও তাই অনুসরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে লেবাননে ধর্মভিত্তিক ১৮ টি ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী বা সেকট বিদ্যমান। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরকার গঠনে অংশ গ্রহণের অধিকার সবকটিরই আছে। সবকটির স্বার্থ রক্ষা করে সমযোতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতা ভাগাভাগি ও বৃহত্তর স্বার্থে তা পরিচালনা কঠিন ব্যাপার। ক্ষমতায় গিয়ে সবাই নিজ নিজ গোষ্ঠী স্বার্থ দেখতে গিয়ে দেশের বৃহত্তর কল্যাণের বিষয় জলাঞ্জলি ডিতে কসুর করেনা। (চলবে)।
Posted ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh