ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
আরব দেশীয় বণিক ও ইউরোপীয় খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পাদ্রীদের অশুভ যোগসাজসে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপে বিক্রি করার হীন প্রক্রিয়া শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। আমেরিকায় ক্রীতদাস ব্যবহার কলম্বাসের আমেরিকা আসার পথ আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে। প্রথম পর্যায়ে নিজেরা বিলাসে-আয়াসে জীবন যাপন করার জন্য বণিক বা আফ্রিকান স্লেভ ট্রেডে নিয়োজিত যারা তাদের বা দালালদের মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে শক্ত সমর্থ কিছু সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রহ করে নতুন আবিষ্কৃত দেশটিতে নিয়ে আসে। এর প্রায় দুই শতাব্দীর ও পরে সময়ের প্রয়োজনে ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে ক্রীতদাসের যোগান দেয়া একটি লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। অনাবাদী হাজার হাজার পাহাড়ি ও সমতলের তৃণভূমি আবাদি জমি তথা শস্য উৎপাদনের খামারে, ফলের চাষে, পশুচারণ ভূমিতে রূপান্তরের কঠিন কাজ, তামাক ও পরবর্তীতে তুলা চাষ, নীল ও ধান চাষ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি কাজে আফ্রিকা থেকে আনা এসব ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে রেললাইন বসানোর কাজে ও এদের ব্যবহার করা হয়। যে মালিক নিলামে ক্রয় করত তার কাছে এসব কৃষ্ণাঙ্গদের আজীবন দাস হয়ে থাকতে হতো। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো বিধায় প্রয়োজনে বিক্রি করা যেতো নিলামে বা অন্য কারো কাছে বা ধার্যকৃত মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে মুক্ত বা স্বাধীন করে ও দেয়া যেতো। মোদ্দাকথা হলো, নিউ ওয়ার্ল্ডে স্থাপিত কলোনীগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবল, পরিশ্রম করতে সক্ষম মানুষের প্রয়োজন থেকেই আফ্রিকার কালো মানুষদের প্রয়োজন ছিলো। ১৬১৯ সালে জুতসই মওকা মিলে। ‘হোয়াইট লায়ন’ নামের একটি জাহাজের নাবিকরা পূর্তগীজ স্লেভ শিপ ‘সাও জাও’ আক্রমন করে বিশজন আফ্রিকানকে ভার্জিনিয়ার জেমস টাউনে নিয়ে আসলে ক্রীতদাস প্রথা শুরু হয়। সতের ও আঠারো শতকে আনুমানিক ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন আফ্রিকানকে এ দেশে আনা হয়। অনেকেই কারাবিয়ানে নিলামে বিক্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের কনফেডারেট এলাকায় ঠাই পায়। এরাই ছিল সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্থ। দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল, মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া সাউথ থেকে জর্জিয়ার প্ল্যান্টেশনের শ্বেতাঙ্গ মালিকরা তাদের দিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটিয়ে নিতো। উত্তরে অবস্থা অনেকটা সহণীয় পর্যায়ের ছিল।
শিল্পকারখানা, কৃষি অর্থনীতির আধিক্যের কারণ ছাড়া ও শিক্ষিত লোকজনের সংখ্যা এ এলাকায় বেশী থাকায় লোকজনের মধ্যে মানবিক গুণাবলী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আধিক্য দক্ষিণের তুলনায় বেশী ছিল। আমেরিকান বিপ্লবের পরে উত্তর থেকেই আফ্রিকান ক্রীতদাসদের মুক্তি আন্দোলনের আহবান ও দাবী উচ্চারিত হয়। রেভুলুসনারী ওয়ার এ ৫,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিক আমেরিকার পক্ষে রণক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধের অবসান হলে নতুন প্রণীত ইউএস শাসনতন্ত্রে দাসপ্রথাকে উচ্ছেদের পরিবর্তে কায়দা করে প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকার করা হয়। তবে, উত্তরের রাজ্যগুলো ১৭৭৪ থেকে ১৮০৪ সালের মধ্যে স্লেভারী অবলুপ্ত করে ফেলে। তব দক্ষিণে ঘৃণিত এ প্রথা চালু থাকে যদি ও কংগ্রেস ১৮০৮ সালে আফ্রিকান দাস বাণিজ্য বন্ধের সিদ্দান্ত নেয়। ইউনিয়নে যোগদানকারী রাজ্য বনাম কনফেডারেট স্টেটগুলোর মধ্যেকার চার বছর স্থায়ী সিভিল ওয়ার শেষ হলে শাসনতন্ত্রে ১৩, ১৪ ও ১৫ সংশোধনী বা এমেনমেন্ড পাশ হয় এবং ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদ করা সহ কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। তবে, আইনে থাকলে ও বাস্তবে প্রয়োগ, বিশেষত দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে, ছিলোনা বললেই চলে।
ইউরোপ থেকে নিউ ওয়ার্ল্ড বা আমেরিকায় আসার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্রাইসিসের দেখা মেলে যা অদ্যাবধি এদেশে বিরাজমান। কোভিড-১৯ এ যখন মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা (২০ জুন ২০২০ তারিখের হিসেবে আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ২,৬৮২,৮৯৭ এবং মৃতের সংখ্যা ১২৯,৫৪৪০) তখন আব্রাহাম লিঙ্কন , জন.ফ কেনেডি এবং মারটিন লুথার কিং জুনিয়র এর মত এই ২০২০ সালে ও বর্ণবাদের শিকার হয়ে জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশের হাতে প্রাণ দিতে হলো। এসব বাস্তবতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, কালোদের অধিকার আদায়ের সপক্ষে যারাই আন্দোলনে নেমেছে তাদেরকেই নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে, এমনকি প্রাণ ও দিতে হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকা শ্বেত সন্ত্রাস বর্তমান সময়ে অনেক জটিল রূপ ধারণ করেছে। উগ্র শেতাঙ্গদের দ্বারা আগ্রাসন শুধুমাত্র দৈহিক নিপীড়ন, পুলিশি জুলুম, হত্য ও জেল-জরিমানা এসবে সীমিত থাকেনি, সাথে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে দারিদ্র্য প্রপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ ,বাদামী, হলুদ, হিস্পানিক ও অন্যান্য রঙের ও বর্ণের, বিশেষত অভিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন কায়দায় মানসিক ও আর্থিক নির্যাতন।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দাস প্রথার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে আব্রাহাম লিঙ্কন এবং জন এফ কেনেডি- এ দুজনের মতো বলিষ্ঠ ও সাহসী বক্তব্য কেউ রাখেননি। এ সত্য সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে যে যারাই কৃষ্ণাঙ্গদের সপক্ষে দাঁড়াবে, হোন না তিনি জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, তাঁকেই উগ্র শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠী টার্গেট করবে। কালোদের অধিকার আদায়ের জন্য যারা আন্দোলন করেছে বা করছে, এমনকি অহিংসাকে মুলমন্ত্র হিসেবে, কৌশল হিসেবে নিয়ে, তাঁদেরও প্রাণ দিতে হয়েছে। মারটিন লুথার কিং জুনিয়র এ ক্ষেত্রে অত্যুজ্জ্বল হলেও জর্জ ফ্লয়েড কম উজ্জল নন। পুলিশর হাতে তার নৃশংস হত্যা সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে আর নরাধম ডেরেক চভিনকে ধিক্কার দিচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ড আফ্রিকান-আমেরিকান ছাড়া ও এ দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্ট্রাইকে দিনের পর দিন যোগ দিতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। সারা বিশ্বেই জাগ্রত জনতা মিছিলে মিছিলে এ হত্যা ঘটনাকে নিন্দা জানানোর সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রশাসন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিন্দায় মুখর। দুনিয়ার মানুষের বুঝতে বাকি নেই যে আপোষহীন বর্ণবাদের কট্টর সমর্থক ট্রাম্প প্রশাসন ও তাদের দোসররা। এদের মন-মগজে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা সময় সময় অবদমিত থাকলে ও সামান্য উস্কানি বা মদদেই স্ফুলিঙ্গ হয়ে দাবানল সৃষ্টি করতে সদাই উদগ্রীব। নির্বাচনের বছরে আর ও কত ফ্লয়েডের প্রাণ এরা কেড়ে নেবে কে জানে!
মানহাচেট হিলস, লংআইল্যান্ড।
৩০ জুন ২০২০
Posted ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ জুলাই ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh