ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
চতুর্থ অংশ : আমার স্মৃতিতে বৈরুত একটি সৌন্দয্যমন্ডিত, সুশোভন ও নয়নাভিরাম নগরী। একথা সত্যি যে সেখানে অবস্থানের শেষ একটি বছরের ও কিছু বেশী সময় নিরন্তর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেঁচে ছিলাম। আমি ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলাম এমন সুখস্মৃতির কিছু স্ন্যাপশট, সীমাহীন কষ্টকাতর কয়েকটি ঘটনার খন্ডচিত্র
ইতোমধ্যেই ন্যু’ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকা তিন পর্বে উপ-সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশ করেছে। আমার ধৈয্যের উপর নির্ভর করবে এটি শেষ পর্ব হবে নাকি পঞ্চম পর্ব পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হবে। আমার প্রিয় পত্রিকাটির সম্পাদক সন্দেহাতীত ভাবে আমার বেলায় ধৈর্য্যের পরিচয় দিচ্ছেন। আমি কৃতজ্ঞ।
আমার জীবনে বৈরুতে অবস্থানের সময়টা এতই ঘটনাবহুল যে আর ও স্মৃতিতর্পণে ও তা শেষ হবেনা। সময়টি ছিল ভর যৌবন, উচ্ছল, উজ্জ্বল এবং ফুরফুরে। বৈরুতের উন্মুক্ত, অবাধ, বাঁধাবন্ধনহীন দিনগুলি অধ্যয়ন, গবেষণা এবং মুক্ত পরিবেশে আনন্দ- উল্লাস, এবং বিনোদনে সময় কাটিয়েছি। তবে, সবসময়ই সচেষ্ট ছিলাম বুঝতে ; চিনতে চেষ্টা করেছি আত্মসত্বার বিভিন্ন দিকগুলো। সমুদ্র, পাহাড়, সমতল ও ভ্যালির অপরূপ সমন্বয়ে বেষ্ঠিত লেবানন দেশটি চষে বেডিয়েছি বিভিন্ন দেশের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। প্রাচীন ঐতিহাসক স্থান, যেমন, বিবলস, টেম্পল অব দি সান, আওতার লেডি অব লেবানন, জেইটা গুহা, বালবেক, বেকা ভ্যালি, কাডিসা ভ্যালি, আন্জারে উমাইয়া আমলের ধ্বংসাবশেষ, উনিশ শতাব্দীতে নির্মিত বেইতদিন প্রাসাদ ইত্যাদি দেখার সুযোগ হয়েছে। ফোনেসিয়ান, রোমান, মুসলিম এবং আধুনিক পুরাকির্তী ও স্থাপত্যকর্ম দেখে বিস্ময় জেগেছে। মূলত লেবানিজ বন্ধু-বান্ধবদের গুটিকয় পারসীয় বন্ধুদের সাহচর্যে বিশ্ববিদযালয় ছুটির
দিনগুলো এ করেই কাটতো। গ্রীষ্মে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের বীচ সত্যিই নয়নাভিরাম ছিল। নিত্যই কিছুক্ষনের জন্য হলে ও যাওয়া হতো। লেবাননের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক খন্দকার গোলাম মুস্তফা। তাঁর ছোট ছেলেটি ও প্রায়ই আমাদের সাথে বীচে যেতে বায়না ধরত। আমরা ক’জন সম্মানিত রাষ্ট্রদূতের তাঁর পত্নী প্রফেসর সাবেরা আপার আদর আপ্যায়ন পেয়েছি প্রচুর। খাজা সেরজিল হাসান ছিলেন সে সময় থার্ড সেক্রেটারী। খাজা দম্পতি ও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেজি মুস্তফা সাব বাগদাদ চলে যান। কেএম শেহাবউদ্দিন কন্সাল জেনারেল হিসেবে আসেন। পারিবারিক একটা বন্ধন হয়ে গিয়েছিল এ পরিবারটির সাথে। তাঁর সাথে আমি সিরিয়া সহ আরো বেশ কিছু স্থান ভ্রমণ করেছি। আমার থাকাকালীন সময়ে জনাব (মরহুম) আব্দুশ শাকুর (প্রাক্তন সিএসপি) বরেণ্য সাহিত্যিক, (মরহুম) ব্রিগেডিয়ার খুর্শেদ (আগরতলা মামলার আসামী), (মরহুম) নুরুল হক (পরিচালক, বিআরডিবি এবং পরবর্তীতে পল্লীউন্নয়ন একাডেমী, বগুড়ার পরিচালক) বৈরুত পরিভ্রমণ করেন। শেষোক্ত দুজন চাকুরী সুবাদে আমার জৈষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। শাকুর ভাই আমার ভাই ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের সহকর্মী ছিলেন বিধায় পূর্ব পরিচিত ছিলেন। নুরুল হক সাব এইউবি এল্যুমনাই ছিলেন। তাঁদের অবস্থান ছিল খুবই অল্প সময়ের। তবে বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তা খুবই উপভোগ্য ছিল।
এহেন আনন্দঘন সময়ে ভাটা পরতে শুরু করে বৈরুতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে। ১৯৭৬ সালে আমি যখন ডিগ্রী শেষ করে দেশে চলে যাই তখন এক বিধ্বস্ত বৈরুত পেছনে ফেলে যাই। নববিবাহিত স্ত্রী কাছে প্রাণ নিয়ে ফিরে যাওয়াতে আনন্দ ছিল কিন্তু প্রিয় শহর বৈরুত, আমার প্রিয় সব বন্ধুদের রেখে যেতে কষ্ট ও হয়েছিল।
বেরুতের অবস্থা সবসময়ই মনযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করেছি, ফেলে আসা বন্ধুবান্ধবদের জন্য উৎকন্ঠা বোধ ও ছিল। আমার সাথে যারা একই সময়ে গিয়েছিলাম তাদের বেশীর ভাগই আমার ডিগ্রী শেষ হওয়ার এক কিংবা দেড় বছর পরে সেখানকার অধ্যয়ন পর্ব শেষ করেছেন। স্কলারশীপের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে ইনসেনটিভ যুগিয়েছে বলে মনে হয়। আমার ক্ষেত্রে বধু ছিল মটিভেশন নিঃসন্দেহে।
পনের বছর ব্যাপ্তির নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধ বৈরুত তথা লেবানন দেশটিকে বিধ্বস্তপ্রায় করে দিলে ও প্রবাসী লেবানিজ এবং ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক ভাবে সবল হতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলো এবং কিছু সংখ্যক বন্ধু রাষ্ট্র, বিশেষত, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসলে সকল মহলে আশার সঞ্চার হয় যে লেবাননের অর্থনীতি, বৈরুতের চাকচমক আবার বুঝি বা ফিরে আসবে। কিন্তু দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বানি আল সদরের ইরানী বাহিনী তথা হিজবুল্লাহর দীর্ঘ সময় যাবত উপস্থিতি, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদের সক্রিয় সমর্থন এবং রাশিয়ার মদদ্ ইসরায়েল ও আমেরিকাকে স্বাভাবিক ভাবেই অন্যপক্ষে টেলে দেয়। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যে সৌদী আরব এবং ইরান রাজনীতিতে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ। এ দুটি দেশের সুন্নী শিয়া বিভাজনের প্রতিচ্ছায়ায়ই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মূল নিয়ামত। প্যালেষ্টাইনে উদ্বাস্তুরা ফ্যাক্টর হিসেবে তো আছেই। লেবাননের রাজনীতিতে এদের উপস্থিতি খুবই দৃশ্যমান। তেমন কোন শক্তিশালী সামরিক ভূমিকা রাখার ক্ষমতা তালা থাকায় দেশটিকে নিয়ে সিরিয়া, ইরান এবং ইসরাইলের টানাহেঁচড়া দীর্ঘদিনের। পূর্বেই বলা হয়েছে যে লেবানন একটি বিভাজিত দেশ। মোট জনসংখ্যার (৬,৮৫৯,৪০৮) ৫৪ শতাংশ মুসলমান, ৪১ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৫ শতাংশ দ্রুজ। আবহমানকাল থেকে ধর্ম, গোত্রগত বিভাজনের কারণে দেশটি রাজনৈতিক ও সামরিক শাসনব্যবস্থা সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রায় সময়েই নিমজ্জমান ছিল। পনের বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক ঘোষণা করে যে লেবানন তার নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র।
এটি শাসন যারা করছে তারা ঘুষ এবং স্বজনপ্রীতির মত পাপাচারের চরমে পৌঁছেছে। মানুষজনের সেবা প্রদানে সামর্থ, সদিচ্ছা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ট যারা তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়না। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সরকার উচ্চ হারে ট্যাক্স আরোপের ঘোষণা দিলে জনতা আক্রোশে ফেটে পরে। হরতাল, জনপথ অবরোধ লাগাতার চলতে থাকলে কোন ফলোদয় হয়নি। বিগত ৪ই আগষ্ট ২০২০ তারিখে ২০১৩ থেকে বৈরুত বন্দরে রাখা ২,৭৫০ মেট্রিক টন এমোনিয়াম নাইট্রেট যা হিরোশিমায় যে এ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেরকম বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরিত হলে ২২০টি প্রাণ বিনষ্ট হয় ; ৩০,০০০ লোকের আবাসস্থান ধূলিস্যাত হয়ে যায়। প্রশাসন কতোটা দূর্বল ও অলস হলে এ পরিমাণ এমোনিয়াম নাইট্রেট (যা আফ্রিকার কোন একটি দেশে পাঠানোর কথা) বন্দরে ছয় বছর যাবত পড়ে থাকে তা অনুমান করা কঠিন নয়। দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ওরম উলভেরাইন স্বজনপ্রীতি লেবাননের প্রশাসন জাঁকিয়ে বসে আছে। আটারোটি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী যেখানে গঠনতন্ত্র মোতাবেক মিলেমিশে একটি বিভাজিত দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ, কল্যাণে কাজ করার কথা সেখানে স্বার্থপরতা ও পক্ষপাতদুষ্ট, গোষ্ঠি স্বার্থ রক্ষার বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়।
৬.৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি অক্টোবরে ইস্তাফা দেন। জানুয়ারী থেকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন হাসান ডিয়াব। তিনি ও বিক্ষোভের মুখে ২০২০’র আগষ্টের ১০ তারিখে পদত্যাগ করেন। তাঁর কেবিনেট ও পদত্যাগ করেছে। পার্লামেন্ট নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত হাসান ডিয়াব আভ্যন্তরীন ব্যবস্থা হিসেবে দায়িত্ব থাকবেন। জনতা এ পরিবর্তনে সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবী হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারের পদত্যাগ।
আমার দেখা বৈরুত আগের মতো নেই। সুন্দর চেহারার সুন্দর মনের লেবানিজ মানুষগুলো পরস্পরের সাথে দ্বন্ধ বিসম্বাদে মানব চরিত্রের কুৎসিত দিকগুলো উন্মোচন করছে নিতান্তই নির্লজ্জ ভাবে। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ব হয়ে সুন্দর লেবানন গড়ার যে বীজমন্ত্র শাসনতন্ত্রে নিহিত তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে অনেক পূর্বেই। ১৫ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধ, বিভাজিত প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, নিম্নমানের আমলাতন্ত্র ইত্যাদি কারণে এককালের সবল অর্থনীতি বর্তমানে চরম দুর্দশাগ্রস্ত। ডলারের বিপরীতে লেবানিজ পাউন্ড অত্যন্ত নিন্মগামী। মূল্যমান শতকরা ৮০ ভাগের ও নীচে। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন লেবানিজ বেকার। গ্রীড ইলেকট্রিসিটি সারাদিনে ঘন্টা দু’য়েকের জন্য ও মিলে না। বৈরুত নগরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিম্ন পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য এবং হাইজিন অবস্থা শোচনীয়। প্রায় সম্পদ শুন্য দেশটির খাদ্যাভাবের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সেভ দি চিলড্রেন বলছে যে শিশু মৃত্যুহার আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ২০২০ শেষ হওয়ার পূর্বেই দূর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। ৬.৯ মিলিয়ন মানুষের ৮৭.২ ভাগই শহরে বসবাস করে। ২ মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত মানুষ আর ৫ লক্ষ মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারের ভীরে শহরগুলো, বিশেষত বৈরুত নগরীর তার পূর্বেকার সৌকর্য্য, সচ্ছল জীবনধারা হারিয়ে আজ প্রায় মিসকিনদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। আমি এবং আর ও অনেক বৈরুত ভক্তদের জন্য নিদারুণ কষ্টের সময় এখন।
Posted ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh