ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন ২০২০
মার্চ ১৫, ২০১৯ একটি কালো , বিষাদময় দিন হিসেবে সারাবিশ্বের মুসলমানদের মনে গভীর শোক বয়ে নিয়ে আসে। আজ থেকে এক বছর আগে এই দিনটিতে নিউ জিলান্ডের ক্রিসট চার্চে দু’টো মাসজিদে একজন অস্ট্রেলিয়ান বন্দুকদারি ৫১ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। নিউজিলান্ডের নাগরিক ছাড়া ও এসব শাহীদানের মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, এবং মিসরের মুসলমান ছিলেন। শান্তিপ্রিয় একটি দেশে এরকম একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার খবর প্রচার হওয়ার সাথে সাথে সারা বিশ্বে আলোড়ন উঠলে ও নিউ জিলান্ডের সদ্যা নির্বাচিত মাত্র ৩৯ বছর বয়স্কা জেসিন্দা আরদেরন (Jacinda Ardern) ধীরস্থিরচিত্তে এমন একটা গুরুতর ঘটনা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভাবে মোকাবেলা করে সকল মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন; কুশলী নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। স্বল্প কলেবরের নিবন্ধটিতে ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডের বিবরণের চেয়ে হত্যা পরবর্তী নেতৃত্ব কাহিনী, তথা নেতা হিসেবে জেসিন্দা’র পারঙ্গমতা ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে সম্মানের স্থান পাওয়ার কাহিনী প্রাধান্য পাবে।
খুব একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন হননি জেসিন্দা। ২০১৭ সালে পার্লামেন্টের সদস্য হয়ে রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ। বছর না ঘুরতেই ৪.৮ মিলিয়ন লোক অধ্যুষিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশটির প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। মাত্র সাত সপ্তাহের সময় পেয়েছিলেন প্রচার অভিযানের। প্রচুর প্রতিকুল অবস্থা পেরিয়ে তাঁর সেন্টার লেফট দল লেবার পার্টি নয় বছর বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বে ও একমাত্র জেসিন্দা’র জনপ্রিয়তার কারণে ৪১ শতাংশ ভোট পায় এবং ফার লেফট গ্রীন পার্টি ও সেন্টার রাইট নিউ জিলান্ড ফার্স্ট দল দুটির সাথে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় আসেন। গ্রীন পার্টি ৫ শতাংশ ভোট আর ন্যাশনাল পার্টি পেয়েছিল ৪৬ শতাংশ। আগামী ইলেকশান হবে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৯ তারিখে। করোনা ভাইরাসের আক্রমন কমে গেলে সময়মতোই ইলেকশান অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এমতাবস্তায়, জেসিন্দা‘র দল ৪৩-৪৫ শতাংশ ভোট পাবে এটা প্রায় নিশ্চিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় ১৯১৬ সালে জন্ম নেয়া পার্টিটির অভিজ্ঞতা খুবই স্বল্প সময়ের- এ প্রচারণা ইতিমধ্যেই জোরেশোরে শুরু হয়েছে। তবে, তিন বছরে জেসিন্দার অভিজ্ঞতার ঝুড়ি এত বেশী ভারী যে প্রধান বিরোধীদল স্বস্তিতে নেই। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে, বিশেষত উগ্র দক্ষিণ পন্থি দল ন্যাশনাল পার্টির তুলনায় ( যদি ও দলটি একনাগাড়ে দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় ছিল) আভ্যনতরিন ও পররাষ্ট্র ফ্রন্টে জেসিন্দার অর্জন অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে দেশে বিদেশে। মুসাল্লি নিধনের খবর যখন পান তখন জেসিন্দা নিউ প্ল্যিমাউথের সন্নিকটে একটি স্কুল পরিদর্শনের পথে রাস্তায় ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন স্থানীয় মেয়র। পুলিশ মিনিস্টারের ফোন পেয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে লোকাল পুলিশ অফিসে যান এবং জনসংযোগের এক কর্মকর্তা নিয়ে কাজে লেগে যান। দিনটি ছিল তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের তিন নম্বর দিবস। তাঁর বিশ্বস্ত অর্থমন্ত্রী গ্রান্ট রবার্টসনের সাথে আলোচনা করে একঘণ্টার ও কমসময়ের মধ্যে তিনি বারতা পাঠ করেন। নিউ জিল্যান্ডের মুসলিম জনগুষ্টির উদ্দেশ্যে মমতা মাখানো হৃদয়ের কোমল অনুভূতি, ইস্পাতসম দৃঢ়টা নিয়ে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে মুসলমানরা শান্তমনে গ্রহণ করে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে।
যে মুন্সিয়ানার সাথে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনা তিনি সকল মহলের প্রশংসা কুড়িয়ে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন তা শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কিত কলাকৌশল বিজ্ঞান, যেমন লোকপ্রশাসন, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদিতে স্থান করে নেবে। এ ঘটনার কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী মুসলমান মহিলাদের মত মাথায় স্কারফ দিয়ে ওয়েলিংটনের এক মসজিদে গেলে সারা মুসলিম বিশ্ব তাকে সাধুবাদ জানায়। তাঁর সময়োচিত হস্তক্ষেপে ফরেনসিক দ্রুত সম্পন্ন করে আত্মীয় স্বজনদের লাশের মুখ দেখানো ও সৎকারের যাবতীয় কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ করা সম্ভব হয় এবং লোকাল পুলিশ ও মুসলমান বাসিন্দাদের মধ্যে বড়ো ধরণের ভুল বুঝাবুঝির তাৎক্ষনিক অবসান ঘটে।
এ ঘটনা সামাল দিতেদিতেই দেশে আগ্নেয়াস্র সীমিতকরণ ও ব্যবহারে প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এটি ও নিউজিল্যান্ডে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। টেক কোম্পানিগুলো যাতে উগ্রপন্তিদের মুসলিম বিরোধী লিফলেট না ছাপে সেজন্য জার্মানির এঙ্গেলা মারকেল, ফ্রান্সের ইমানুয়েল মেক্রন প্রমূখ বিশ্ব নেতাদের সাথে আলোচনা করেন। তাছাড়া, মাইক্রোসফটের ব্রাড স্মিথ , ফেসবুকের জুকারবারগ, ইউটিউবের সুসান , টুইটারের জাঁক ডোরসে এদের সাথে ও সরাসরি কথা বলেন। আর ঠিক দু’মাস পর পারিস এ প্রধানমন্ত্রী আরদেন জিলেন্দা , আঙ্গেলা মারকেল ও ইমানুয়েল মেক্রন এই তিন নেতার আহবানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও টেক কোম্পানিগুলোর প্রধানরা একত্রিত হয়ে ক্রিসচার্চ প্রটোকল সই করে। এর ফলস্রুতিতে টেরর সংক্রান্ত ধংসাত্ব্ক ছবি ও খবর প্রচারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
আরডারন মুসলমান, আদিবাসী মাওরিসহ যারাই তাঁর দেশের নাগরিক সবাইকে একই নজরে দেখার পক্ষে। এ মনোভাব তিনি পলিসি প্রণয়নে ও আন্তরিক এবং শক্তভাবে প্রয়োগ করেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণে তিনি দারুণ আন্তরিক। এক্ষেত্রে তিনি সমমনা দেশের , যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ফিজি এবং আইসল্যান্ড এর সাথে সমঝোতা চুক্তি সই করেছেন। তাছাড়া, নারী উন্নয়ন, পুরুষ নারীর বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনা, এলজিবিটিকিউআই (LGBTQI ) এবং মেণ্টাল হেলথ ও মানসিক প্রতিবন্দি নিয়ে নিরলস ভাবে কাজ করছেন।
হাউজিং সেক্টরে নিউ জিল্যান্ডে প্রচুর সমস্যা বিদ্যমান বিধায় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রচুর কাজে হাত দিয়েছেন। তবে প্রবল বিরোধিতা রয়েছে নাজুক এ সেক্টরে। তাঁর এর একটি পছন্দের কাজ এবং চ্যালেঞ্জ ও বটে এর তাহলো বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করা। শিশু উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তিনি বাধার সম্মুখীন হচেছন। বয়স্কদের প্রোগ্রাম দেশটিতে দারুণ ভাল তবে শিশুদের প্রোগ্রাম এর সাথে সমতা আনতে বাজেটের উদ্বৃত্ত আয় আনতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অর্জনের হিসেবে আগামী নির্বাচনে জেসিন্দা আরডেন জিতে আসার কথা। তাঁর সাথে গ্রীন পার্টি যদি পাঁচ শতাংশ ভোট ও পায় তবে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিশ্চিতই বলা যায়। তাছাড়া , তিনি যে ভাবে কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণ করছেন তা সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসের ২৮ তারিখে প্রথম কেস সনাক্তের সাথে সাথে লেভেল ৪ লক ডাউন ঘোষণা দেন। দ্বীপ দেশ হওয়ার সুবিধা পেয়েছে সত্যি তবে ত্বরিত সঠিক সিদ্দান্ত নেয়ায় সনাক্ত হয়েছে এমন ১৫০৪টি কেসের মধ্যে মাত্র ২২ জন মারা যায়। করোনা কালে মন্ত্রীদের বেতন ২% কমিয়ে দেন। এসব সময়োচিত সিদ্দান্ত তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেছে এবং সারা বিশ্বে অনুকরণ করার মত একজন আদর্শ নেতার আসনে সমাসীন করেছে।
Posted ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh