ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০২০
৫ম অংশ : ২০২০ নির্বাচনের আর মাত্র দু’ সপ্তাহ বাকী । সংশয় , আগ্রহ , নানান ধরণের ঘটনা সব মিলিয়ে যে নাটকীয়তা তার ছত্রচ্ছায়ায় ইতোমধ্যেই ২৮ মিলিয়নের বেশী লোক ভোট দিয়ে ফেলেছে । ধারণা করা হচ্ছে এ ক’দিনে এ সংখ্যা ৪০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে । কোর্টে (ফেডারেল এবং ষ্টেট ) বেশ কিছু মামলা ঝুলছে নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে যে কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে দু’দলই । কয়েকটির রায় বের হয়েছে । ফেনসালভেনিয়া ভোট একস্টেনশন নিয়ে মামলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর দল হেরে গেছে । মিশিগান নিয়ে দু’দলের টানাহেঁচড়ায় পরিস্হিতি বেশ উত্তপ্ত । আর ও কয়েকটি ষ্টেটে ও অবস্হা বিস্ফোরণমূখ অবস্হায়। উইসকনসিনে রিপাবলিকানদের আপত্তি সত্ত্বে ও কোর্ট করোনার কারণে ২০ অক্টোবর তারিখ থেকে আগাম ভোট শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে । সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান দলের কর্মকান্ডে সমর্থন বাড়ানোর তৎপরতায় মনে হচ্ছে তেসরা নভেম্বরের পূর্বেই নতুন বিচারপতি যোগ দিবেন । ৫-৪ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি নিরাপদ বোধ করবে মনে হলে ও ইলেকশনে বাইডেন জিতলে এ ইকুয়েশন ধোপে নাও টিকতে পারে । প্রেসিডন্ট ট্রাম্প মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন যাতে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে। পোষ্টাল ভোট পৌঁছার সর্বশেষ তারিখ এবং গণনা নিয়ে ও ইস্যু তৈরী করতে জাষ্টিস ডিপার্টমেন্টের সহায়তা নিয়ে দলটি কাজ করছে বলে যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় নিত্যই বয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্হিতিতে যুক্তরাষ্টে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে নির্বাচন পদ্ধতি বা কৌশল অনুসরণ করা হয় তার উপর আলোকপাত করা জরুরী বলে মনে করছি । একটি পদ্ধতি হলো ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট এবং অন্যটি পপুলার ভোট । গোর এবং হিলারী ক্লিনটন পপুলার ভোট বেশী পেয়ে ও ইলেকটোরাল কলেজ সদস্যদের ভোট প্রতিদন্ধীদের চেয়ে কম পাওয়ায় নির্বাচনে হেরে যান।
ভোটারগণ ব্যালটের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস -প্রেসিডন্ট বাছাই করেন সত্যি কিন্তু রাজ্য-ভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুসরণ করে তবেই নির্বাচনে চূড়ান্ত বাছাইকরণ করা হয়। পদ্ধতিটি বেশ জটিল । ইলেকটরস্ প্রতিটি ষ্টেটে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতেই বাছাই করা হয় । ৪৮ রাজ্যেরই বাছাই করা ইলেকটরস্ তাদের স্ব স্ব ষ্টেটে প্রেসিডেন্ট পদে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পান তাকে এবং তার সমর্থিত বা পার্টনার ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে ওয়াদাবদ্ধ (pledged votes) । মেইন এবং নেব্রাস্কা একটু ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে । সেখানে দুজন ইলেক্টরস যে প্রার্থী বেশী ভোট পেয়েছেন তাকে এবং তৃতীয় জন যে প্রার্থী সর্বাধিক কংগ্রেসনাল ডিষ্টিক্টে জয়লাভ করেছেন সে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে ওয়াদাবদ্ধ ।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রেসিডন্টেসিয়াল ইলেকশন নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে হলে ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটদাতারা ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ভোট দেন । ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে প্রতিটি ষ্টেট একটি প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন চক্রে (পুপষব) কি সংখ্যক ইলেকটর থাকবেন তা নির্ভর করে রাজ্যটি থেকে কতজন নির্বাচিত প্রতিনিধি কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করছেন । উল্লেখ করা যায় যে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টটিভে আসন সংখ্যা ৪৩৫ জন । ৫০টি ষ্টেট তারা প্রতিনিধিত্ব করেন । প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যা আদমশুমারী যা প্রতি ১০বছর ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয় তার উপর ভিত্তি করে প্রতিনিধি সংখ্যা নির্ধারিত হয় । সিনেটের ১০০ টি আসন বন্টনে সেন্সাসের জনসংখ্যা তথ্য লাগে না । আয়তনে ছোট হোক বা বড় হোক তাতে কিছু আসে যায় না । প্রতি ষ্টেট থেকে ২ জন করে জনপ্রিয় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন । সুতরাং ৫০ টি ষ্টেটের ইলেকটর সংখ্যা ৫৩৫ । ফেডারেল ডিষ্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার ৩ জন বা সাকুল্যে ৫৩৮ জন । নির্বাচনে জিততে হলে একজন প্রেসিডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রাথীকে কমপক্ষে ২৭০ জন ইলেকটরের ভোট পেতে হবে।
জনপ্রিয় ভোট কে কত সংখ্যক পেলেন তা ফলাফল নির্ধারণে বিবেচ্য নয় । সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ হলো জনপ্রিয় ভোট বেশী পেয়ে ও আল-গোর এবং হিলারি ক্লিনটনে ইলেকটর ভোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে কম পাওয়ায় হেরে যাওয়া । তবে , জটিলতা ও আছে কারণ ইলেকটর ভোটের স্বপক্ষে কোন কনষ্টিটিউশনাল বা বিধিবদ্ধ আইনের বিধান নেই বিধায় ইলেকটরগণ ওয়াদার বরখেলাপ ও করতে পারেন । কিছু ষ্টেটে আবার ওয়াদা ও আদায় করা হয় না । এক্ষেত্রে Faithlessness electors নিয়ে , একবার অন্তত বিপাক ঘটেছিল । ১৮৩৬ সালে ভার্জিনিয়ার ২৩ জন ইলেকটর ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রিচার্ড এম জনসনকে ভোট প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ফলাফল টাই (tie) হয় । চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয় সিনেট ভোটে যা জনসনের পক্ষেই যায় । তবে, ‘প্লেজড ইলেকটর’দের ক্ষেত্রে এমনটি কখনো হয়নি ।
এ পর্য্যায়ে বর্তমান গদ্দানশীল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির আদর্শ ও দর্শন নিয়ে কিছু তথ্য সাধারন পাঠকদের অবগতির জন্য দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি । পার্টিটি জিওপি (GOP/Grand Old Party) নামে সমধিক পরিচিত । ১৬৬ বছর পূর্বে ১৮৫৪ সালে মার্চ মাসের ২০ তারিখে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এর পূর্বে Whig party, Free Soil Party, Liberty party , Anti-Nebraska party, North American Party ইত্যাদি নামে পরিচিত দলগুলো আদর্শ ও উদ্দেশ্য সমুন্নত রাখতে রিপাবলিকান পার্টিটি গঠিত হয়।
জিওপি যে বিষযগুলোকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে সেগুলোর মধ্যে রক্ষণশীলতা বা কনজারভেটিজম , নিন্ম হারে ট্যাক্স , মুক্ত বাজার অর্থনীতি বা ক্যাপিটালিজম , শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে উদার তহবিল প্রদানসহ সমরাস্র আধুনিকীকরণের ব্যয় , নাগরিকদের অস্র রাখার অধিকার প্রদান , অভিবাসী আগমণে কড়াকড়ি , ভ্রুণ নষ্ট বা এবরশনের ব্যাপারে কড়া নিয়ন্ত্রণ , ডি-রেগুলেশন এবং লেবার ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে কড়া বিধি নিষেধ , ইত্যাদি । সংক্ষেপে বলা যায় কনজারভেটিজম , আর্থিক বিষয়ে রক্ষণশীলতা (fiscal conservatism) , করপোরেশন ডি-রেগুলেশন সহ সামাজিক রক্ষণশীলতা । দলটিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের নিরিখে বেশ কিছু বিভক্তি আছে ।
উল্লেখযোগ্য কয়টি হলো সেনট্রিজম, লিবার্টারিয়ানিজম, নিও-কনজারভেটিজম, রাইট উইং পপুলিজম ইত্যাদি । রিপাবলিকান মডারেটদের মধ্যে তেত্রিশ কোটির ও বেশী রেজিষ্টার্ড বা এস্টাব্লিষ্টমেন্ট রিপাবলিকান ছাড়া ও টি-পার্টির সদস্য , ফ্রিডম বা পপুলিষ্ট দলসহ উগ্র ডানপন্হীরা ও আছে । গ্রাম এলাকার অনেকেই এ দলের সমর্থক। আমেরিকান হোয়াইট ছাড়া ও ইভানজেলিকান ক্রিটিয়ান এবং চরম রক্ষণশীল ইহুদী সম্প্রদায়ের অধিকাংশই রিপাবলিকান দলের অনুগত।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯ জন রিপাবলিকান বা জিওপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এক সময়ে সমাজ পরিবর্তনে উদার নীতিমালার ধারক দলটির বর্তমান আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী । বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে দলটির প্রথম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিন্কন ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ডানপন্হী আদর্শই বিগত একশ বছর ও দু দশক যাবত দলটি রাজনীতি তথা প্রেসিডেন্টসিয়াল ইলেকশনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করে যাচ্ছে । ১৯৬৪ সালের সিভিল রাইটস্ এ্যাক্ট এবং ১৯৬৫’র ভোটিং এ্যাক্ট পাস হওয়ার পরবর্তীতে দলটির কেন্দ্রস্হল সাউথের রাজ্যগুলোতে স্হানান্তরিত হয়ে যায় ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি আমেরিকায় ‘আমেরিকান স্বপ্নের পরিবর্তে সমাজতন্ত্র ভর’ (American Dream Vs. Socialist Hell-Hole) শ্লোগান তুলে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করার যে অপচেষ্টা করছেন তা কতটুকু কার্যকরী হবে তাই এখন দেখার বিষয় । তবে , ২৮ মিলিয়ন যারা ইতোমধ্যেই ভোট দিয়ে ফেলেছেন তাদের অধিকাংশই ডেমোক্রেট পার্টির সমর্থক বলে যে খবর প্রচার মাধ্যমে আসছে তা সত্য হলে বড়ো ধরণের বিভ্রাট ব্যতিরেকে রিপাবলিকান দল সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না । এ ক’দিনে নিশ্চয়ই আরো অধিক হারে ভোট পড়বে কারণ এখনো সব অপশনই খোলা আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর উগ্রপন্হী সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে চোখ কান খোলা রাখার যে খোলামেলা নির্দেশ দিয়েছেন তা অনেক ভোটারের ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলেছে বিধায় তারা পোষ্টাল ব্যালট, আগাম ভোট, এবং এবসেন্টি ভোট দেয়ায় প্ররোচিত করছে । এর প্রতিফলন ও ভোটের ফলাফলে প্রভাব ফেলবে ।
(পরবর্তী সংখ্যায় ডেমোক্রেটিক পার্টির বিবর্তন ও আদর্শ , উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা হবে ) ।
Posted ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh