ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১
তৃতীয় পর্ব : পরস্পর থেকে এগারো হাজার বর্গমাইলের ও বেশী ভৌগলিক দূরত্বে এদের অবস্থান হলে ও যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ও বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবনের মধ্যে সাজুস্য ও অনেক। ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে ৩৯টি উপজাতি বাস করে আসছে দুই শতাব্দির ও বেশী সময় যাবত। এর মধ্যে আদিবাসী হিসেবে (indigenous) পরিচিত পাঁচটি- ওসাগে (Osage), ক্যাডো (Caddo), কিওয়া (Kiowa), কমানচি (Comanche) এবং উইচিতা (Wichita)। সর্বাধিক জনসংখ্যা হচ্ছে চেরকি উপজাতিয়দের (২০১০ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৯৯,৮৬২ যার মধ্যে ১৮৯,২২৮ জন ওকলাহোমায় বসবাস করে); সর্বনিন্ম মদক (Modoc) উপজাতির লোকসংখ্যা মাত্র ২০০ জন (ওকলাহোমায় বাস করে ১২০ জন)। তবে, চেরকি, ছকতাও, চিকাসাও ক্রীক এবং সেমিনল -এই পাঁচটি ট্রাইব ওকলাহোমা ও তুলসার ৪৩% ভূমির মালিক। এগুলো কেন্দ্রিয় সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী রিজারভেশন বা আদিবাসী ইন্ডিয়ান ট্রাইবের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা ভুমি অঞ্চল। ইন্ডিয়ান ট্রাইবাল স্বায়ত্ত শাসিত ধরনের সরকার এ সব নেশন ষ্টেটে প্রচলিত বিধায় ষ্টেট গভর্নমেন্টের আইন এখানে কার্যকর নয়।
বাংলাদেশের বান্দরবন পার্বত্য জেলা কেন্দ্রীয় সরকারের আইনের আওতাভুক্ত হলে ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কমিউনিটি ব্যবস্থিত প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষণীয়। যদিও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৪৫% দেশের সর্ব দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত তিনটি পার্বত্য জেলায় বসবাস করে, কিন্তু এখানকার আদিবাসী মঙ্গোলীয় চেহারার লোকজন ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাবাস, জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদি নৃতাত্ত্বিক নিরিখে মূল জনগুষ্টি অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষীদের চেয়ে ভিন্নতর। ৪.৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বান্দরবন জেলার জনসংখ্যা ২০১১ আদমশুমারি অনুযায়ী ৩৮৮,৩৩৫ জন। আদিবাসীদের চেয়ে বাঙ্গালীদের সংখ্যা বিগত তিন-চার দশকে অনেক বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পায় (দেখুন : BAN: Second Chittagong Hill Tracts Rural Development Project. ANZCEC Ltd for the Ministry of Chittagong Hill Tracts Affairs and Asian Development Bank, March 2011)।
শিক্ষার হার ৪৩ শতাংশ। বুমং সার্কেলে রাজাই উপাধিধারী উপজাতি প্রধান। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালের রেগুলেশন অনুযায়ী প্রতি সার্কেলে একজন করে চীফ ছিলেন জার তত্ত্বাবধানে হেডম্যান, প্রতি গ্রামের কারবারীদের সহায়তায় খাজনা সংগ্রহ করতেন। এ কাঠামো স্থানীয় পর্যায়ে সালিশি বিচার-আচার, কমুনিটি উন্নায়ন মূলক কাজকর্ম ইত্যাদির জন্য দায়ী ছিল। এখনো এ কাঠামো বর্তমান তবে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, ইত্যাদি দেশের প্রচলিত আইন ও নিয়মে চালু আছে দেশে অন্যান্য জেলার মতই। বান্দরবনে জেলা প্রশাসন ও ট্রাইবাল প্রশাসনের পাশাপাশি একটি আর্মি ক্যান্টনমেন্ট আছে। উল্লেখ্য যে পুরো অঞ্চলটি দুর্গম পাহাড় পর্বত অধ্যুষিত এবং সীমান্তবর্তী বিধায় ক্যান্টনমেন্টের উপস্থিতি সুরক্ষা নিশ্চিন্ত করতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করার সংগত কারণ আছে। বছর পাঁচেক পূর্বে হাতে নেয়া থাঞ্ছি-আলিকদম রোড (সমুদ্র পৃষ্ঠার ২৫০০ ফিট উপরে) সম্পন্ন হওয়ায় পার্বত্য জেলাটির উন্নয়ন, অর্থনীতি, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, টুরিজম ইত্যাদি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
২০১৯ সালে বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক। প্রথম বারের মত দেশে স্থাপিত এমন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সরকার পক্ষে বান্দরবন তথা পার্বত্য জেলা তিনটির নির্বাচিত সংসদ প্রতিনিধি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উ সে সিং (Bir Bahadur U Shew Sing) এবং বান্দরবন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য সেওয়ে হলা (Kzaw Shewe Hla) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বান্দরবনের এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন স্থাপন একটি বিরাট পদক্ষেপ ছিল। এর ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্টি বোর্ডই মূলত তহবিল সংগ্রহ ১০০ একর জমি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রদানের ব্যবস্থা , প্রথম ও ফাউন্ডার উপাচার্য হিসেবে সুবিদিত শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশাসনে অভিজ্ঞ প্রফেসর (ডক্টর) ইমাম আলী’কে বাছাই ও নিয়োগ দেয়ার মত দুরূহ কাজগুলো সুসম্পন্ন করতে পেরেছে। কভিড -১৯ প্যান্ডেমিক বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা প্রচুর বাধাগ্রস্ত করেছে সত্যি তবে উপাচার্য এবং তাঁর সহকর্মী ডীন, রেজিস্টার (registrar) ও উপদেস্টাগণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। সিলেবাস প্রণয়নে অগ্রগতির সাথে সাথে দেশে বিদেশের অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের ক্লাস নেয়া, সেমিনার-সিম্পোজিয়ায় সংযুক্ত করার প্রচেষ্টা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলছে বলে উপাচার্য জানিয়েছেন।
উপরে বিধৃত সাংগঠনিক আম্ব্রেলা (umbrella), সুপরিচিত, যোগ্য, কর্মী পুরুষ মহিলাদের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য -লক্ষ্য, সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা তথা মিশন ও ভিসন (Mission and Vision) ঐকমতের ভিত্তিতে স্থির করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ। ইন্ডিয়ান নেশনগুলোতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিরাজমান দুর্বিষহ অবস্থা দূর করার অভিপ্রায়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা শুরু হয় প্রায় দেড় যুগ আগে। ওকলাহোমার চেরকিদের আবাসস্থান রাজধানী থলেকুয়া’তে (Tahlequah) চেরকি ভূমির উপর হেসটিংস হাসপাতালে স্থাপিত কলেজ অফ অস্তেওপ্যেটিক মেডিসিন (College of Osteopathic Medicine) স্কুলটি প্রাইভেট-পাবলিক উদ্যোগে এ জাতীয় প্রথম উদ্যোগ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে উপজাতীয়দের জন্য। এর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা উপজাতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, এবং প্রতিষ্ঠান, যথা ওকলাহোমা ষ্টেট ইউনিভার্সিটি, সার্বভৌম ট্রাইবাল গভর্নমেন্ট থেকেই এসেছে। আরও যুক্ত হয়েছে ডব্লিও ডব্লিও হেস্টিংস হসপিটাল, চেরকি নেশন বিজনেস, ইউ এস পাবলিক হেলথ সার্ভিসেস কমিশন এবং তুলসা ও ওকলাহোমার বাইরের সাতটি কমুনিটি। পুরো প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ওকলাহোমার উপজাতিগুলোতে আমেরিকান ইন্ডিয়ান ডাক্তার এবং গ্রামীণ এলাকাগুলোর স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের মত উপজাতীয় ডাক্তারের মারাত্মক ঘাটতি পূরণ করার জন্য রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম এবং মেডিকেল ডিগ্রী প্রোগ্রাম চালু করা।
বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ও এমনতরো ধ্যানধারণা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা কাজ করেছে। বান্দরবনের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওকলাহোমায় চেরকি নেশনে ডিও প্রোগ্রাম চালু এবং এর জীবনীশক্তি সঞ্চারণে ডীন উইলিয়াম পেটিট ডি ও অক্লাত পরিশ্রম করে যে স্বপ্নকে বাস্তবের পথে নিয়ে যাচ্ছেন সফলতার সাথে, বান্দরবন ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য প্রফেসর ইমাম আলী ও একই সঙ্কল্পে প্রতিষ্ঠানটিকে উচ্চশিক্ষার একটি আদর্শ বিদ্যাপিঠ হিসেবে রূপায়িত করবেন বলে বিশ্বাস। দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা, পল্লী উন্নয়ন, প্রকল্প রূপকার ও ব্যবস্থাপনা (Project Design and Management) এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসন্দেহে বলতে পারি , সময়ের চাহিদা , কমিউনিটির প্রয়োজন, দেশের আর্থসামাজিক প্রগতির কথা মনে রেখে শিক্ষার বিষয় ও সিলেবাস বাছাই ও প্রচলন করার উপর বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রায়োগিকতা নির্ভর করবে। শিক্ষক বাছাইয়ে ও এসব প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। শ্রম বাজার, আর্থসামাজিক বাজারের চাহিদা, আধুনিক প্রযুক্তি করায়ত্তে পারঙ্গমতা অর্জনে ছাত্রছাত্রীদের সর্বতো সহায়তা যাতে তারা বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে দেশ, সমাজ ও কমিউনিটিকে সমৃদ্ধ করতে পারে সে সব দিকে নজর রাখতে হবে। সমাজ বদলানোর কারিগর, সৈনিক তৈরি করার মহান দায়িত্ব পালন করতে হলে সমাজের রূপ, বৈশিস্ট, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইত্যাদির সাথে এদের নিবিড় পরিচয় করানোর শিক্ষা দিতে হবে যা চৈতন্য আনয়নে ভূমিকা রাখবে। বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। এখনি সুস্থ , উপযোগী শিক্ষার মূল কাঠামো সাজাতে হবে।
Posted ২:১২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh